রাষ্ট্রক্ষমতার রদবদলে মারাত্মক অর্থ ও খাদ্যসংকটে পড়া আফগানিস্তানের মানুষজন দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে এবং নগদ অর্থের বন্দোবস্ত করার লক্ষ্যে ঘরের থালাবাসন, হাঁড়ি-পাতিল, বালিশ, কম্বলের মতো অসংখ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করতে সেগুলো নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা সোমবারের প্রতিবেদনে এমন খবর জানিয়েছে।

চারটি কার্পেট নিয়ে সোমবার কাবুলের চামান-ই-হোজোরি এলাকায় দেখা যায় শাকরুল্লাহকে। নগদ অর্থের সংকুলান করতেই এগুলো নিয়ে তিনি পথে নেমেছেন। শাকরুল্লাহ বলেন, ‘আমি ৪৮ হাজার আফগানি মুদ্রা (৫৫৬ ডলার) দিয়ে কার্পেটগুলো কিনেছিলাম। কিন্তু এখন বোধহয় এসব বিক্রি করে পাঁচ হাজারের বেশি পাবো না।’

চামান-ই-হোজোরি এলাকায় শাকরুল্লাহর মতো অসংখ্য মানুষ যার যা ছিল তাই সঙ্গে এনেছেন বিক্রি করবেন বলে। সেখানকার মানুষের কাছে ফ্রিজ, কুশন, সোফা, ফ্যান, বালিম, কম্বল, দস্তার হাঁড়ি-পাতিল, খাট, বিছানার চাদর, ম্যাট্রেস, রান্নার পাতিল, চামচ এমনকি ঘরের পর্দার মতো শত শত নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখা যায়।

খোলা মাঠে সারিবদ্ধ করে রাখা এসব জিনিসপত্রে পড়েছে ধুলোর আস্তরণ। কয়েক দশকের রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও খরার ওপর সাম্প্রতিক নৈরাজ্য ফল খোদ রাজধানী কাবুলের এই চিত্র। অথচ এসব সামগ্রী বছরের পর বছর ছিল প্রতিটি পারিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী। একমুঠো খাবারের জন্য অল্প দামে এগুলো এখন বিক্রি করা হচ্ছে।

গত ১৫ আগস্ট রাজধানী কাবুলে ঢোকার মধ্য দিয়ে গোটা আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আফগানদের নগদ অর্থের সংকট দেখা দেয়। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে অর্থপ্রবাহ বন্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের রিজার্ভ আটকে দেওয়ায় পরিস্থিতি এখন চরম আকার নিয়েছে।

যার বাড়িতে যা আছে তাই বিক্রি করছেন অর্থকষ্টে থাকা আফগানরা।

আফগানিস্তানজুড়ে ব্যাংকব্যবস্থা এখনো সচল হয়নি। মধ্যবিত্তরাও অর্থ উত্তোলন করতে পারছে না। অনেকে তুলতে পারলেও সপ্তাহে তার সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার আফগানি। নতুন সরকার রিজার্ভে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। সব মিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ।   

শত শত আফগান ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেও শাকরুল্লাহর মতো আফগানদের সেই উপায় নেই। দেশজুড়ে নগদ অর্থের সংকট দেখা দেওয়ায় তারা পড়েছে আরও বিপদে। তাইতো নিত্যব্যবহার্য যা আছে তাই বিক্রি করা ছাড়া অর্থ সংকুলানের পথ নেই তাদের।  

শাকরুল্লাহর পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ৩৩। গত এক বছর ধরে তার একটি ঘরে বসবাস করছেন। কোনোরকম ভাবে দিন কাটছিল পরিবারটির। কিন্তু গত ১৫ আগস্টের পর পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। শাকরুল্লাহ বলছেন, ‘অন্ততপক্ষে আটা, চাল আর তেলার কেনার ব্যবস্থা তো আমাদেরকে করতে হবে।’  

তবে আফগানিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির দেশ ছেড়ে পালানো এবং তালেবানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আগে থেকেই আফগান অর্থনীতির অবস্থা ছিল নাজুক। কোভিড মহামারি শুরু হওয়ার পর যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এছাড়া কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশটিতে খরা দেখা দেওয়ায় পরিস্থিতি এখন শোচনীয়।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী আফগানিস্তানের জিডিপির অন্তত ১০ শতাংশ বিদেশি সাহায্য। গত বিশ বছরে আফগানিস্তানের জিডিপির ৪০ শতাংশ এসেছে আন্তর্জাতিক শতাংশই ছিল আন্তর্জাতিক সহায়তা। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না জানিয়ে অনেক দেশ ইতোমধ্যে এই সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, আগামী বছরের মাঝামাঝি আফগানিস্তানের ৯৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। যুদ্ধকবলিত দেশটির আসন্ন মানবিক সংকট এড়াতে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস দাতাদের কাছে ৬০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।

এএস