আফগানিস্তানের তালেবান সরকারে যাকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মধ্যপন্থী হবে বলে আশা করেছিল, কাবুলের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে নাটকীয় গোলাগুলির ঘটনার পর তালেবানের সেই নেতা আড়ালে চলে গেছেন। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে আক্রান্ত হওয়ার পর তার আড়ালে চলে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা।

আফগান সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর সবচেয়ে পরিচিত মুখ মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; চলতি মাসের শুরুর দিকে কাবুলের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের একজন নেতার আক্রমণের শিকার হন তিনি। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এসব তথ্য জানিয়েছেন সেদিনের আলোচনায় অংশ নেওয়া তালেবানের কয়েকজন নেতা।

তারা বলেছেন, আলোচনায় মোল্লা বারাদার অন্তর্ভুক্তিমূলক মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন; যে মন্ত্রিসভায় অ-তালেবান নেতা, জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি চেয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এ ধরনের মন্ত্রিসভা গঠন করা হলে পুরো বিশ্বের কাছে তা বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। বৈঠকের এক পর্যায়ে চরমপন্থী গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা খলিল উল রহমান হাক্কানি তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান এবং মোল্লা আব্দুল গনি বারাদারকে কিল-ঘুষি মারতে শুরু করেন।

হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা খলিল উল রহমান হাক্কানি মোল্লা আব্দুল গনি বারাদারকে কিল-ঘুষি মারেন
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সূত্রগুলো বলছে, পরে তাদের দেহরক্ষীরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে একে অপরকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। এতে তাদের অনেকে নিহত এবং আহত হন।

এই ঘটনার পর অক্ষত অবস্থায় রাজধানী কাবুল ছেড়ে কান্দাহারে তালেবানের ঘাঁটিতে তাদের সর্বোচ্চ ও আধ্যাত্মিক নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার কাছে চলে যান বারাদার

তালেবানের বাইরে কাউকে না নিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার সদস্যদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, মন্ত্রিসভার ৯০ শতাংশ সদস্য দেশটির জাতিগত পশতুন সম্প্রদায়ের। হাক্কানি পরিবারের সদস্যরা অন্তত চারটি পদ পান; এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীর তালিকায় থাকা হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা সিরাজউদ্দিন হাক্কানি ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচিত হন। আফগানিস্তানের যে দু’জন উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; মোল্লা বারাদার তাদের একজন। ২০১৬ সালের দিকে হাক্কানি নেটওয়ার্ক এবং তালেবান একীভূত হয়ে যায়।

মন্ত্রিসভা গঠনের আলোচনার সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান কাবুলে ছিলেন; তিনি বারাদারের পরিবর্তে হাক্কানিদের সমর্থন দেন। শান্তি আলোচনায় অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পাকিস্তানের কারাগারে আট বছর বন্দি থাকা বারাদারকে মুক্ত করেছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন।

বারাদারের পরিবর্তে স্বল্প পরিচিত মোল্লা মোহাম্মদ হাসানকে উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। কারণ ইসলামাবাদের সঙ্গে হাসানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে এবং তিনি হাক্কানি নেটওয়ার্কের জন্য হুমকি নন। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর গণমাধ্যম শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সাড়া দেয়নি।

গত ১৫ আগস্ট ক্ষমতা দখলের পর কাবুলে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে প্রবেশ করে তালেবানের সশস্ত্র সদস্যরা
তালেবানের সদস্যরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার খবর অস্বীকার করে আসছেন। গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন টেলিভিশনে এসে নিজের আহত কিংবা নিহত হওয়ার খবরকে ‌‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেন মোল্লা বারাদার।

গত ১২ সেপ্টেম্বর কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল-থানিকে কাবুলে শুভেচ্ছা জানাতে উপস্থিত ছিলেন না তিনি। এমনকি চলতি সপ্তাহে তালেবানের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেও তাকে দেখা যায়নি।

টেলিভিশনে সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। আমি নিরাপদ এবং সুস্থ আছি। গণমাধ্যমে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদের যে খবর এসেছে তা একেবারে সত্য নয়।’

কাতারি প্রতিনিধিদলকে শুভেচ্ছা জানানোর অনুষ্ঠানে নিজের অনুপস্থিতির ব্যাপারে সব জল্পনা-কল্পনারও অবসান ঘটান। উপসাগরীয় এই দেশটিতে মোল্লা বারাদার কয়েক বছর ধরে অবস্থান করছিলেন এবং সেখান থেকে আফগানিস্তানের দুই দশকের যুদ্ধের অবসানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে শান্তি আলোচনায় নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি।

বারাদার বলেন, ‘আমি কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের ব্যাপারে জানতাম না। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাবুল সফরের সময় ভ্রমণে ছিলাম। আমি সফর সংক্ষিপ্ত করে কাবুলে ফিরতেও পারতাম না।’

টেলিফোনে তালেবানের মুখপাত্র বিলাল কারিমি ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘বারাদার আড়ালে চলে যাননি। আমরা আশা করছি, তিনি শিগগিরই ফিরবেন।’

সূত্র: ব্লুমবার্গ।

এসএস