ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলের অপেক্ষায় রাজ্যজুড়ে টানটান পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কারণ গত বৃহস্পতিবার শেষ হওয়া এ উপনির্বাচনের ফলেই যে নির্ধারিত হবে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। তৃতীয়বারের মতো কি মমতাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসতে চলেছেন, নাকি ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়ালের কাছে ভবানীপুরে হারতে যাচ্ছেন?

মমতার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণী এই নির্বাচনের ফল জানা যাবে রোববার। বৃহস্পতিবার ভবানীপুরের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয় সকাল ৭টায়। ভোটগণনা শেষে ৩ অক্টোবর অর্থাৎ রোববার ফল প্রকাশ করা হবে।

মুখ্যমন্ত্রিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভবানীপুরের এই উপনির্বাচনে জয়ের বিকল্প নেই মমতার। কারণ গত এপ্রিল-মে মাসে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম বিধানসভা আসনের নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন মমতা। ভারতের নির্বাচনী বিধি বলছে, কোনও জনপ্রতিনিধি ভোটে হেরে পদে আসীন হতে গেলে তাকে ছয় মাসের মধ্যে ফের নির্বাচনে জয়ী হতে হয়।

তবে এই উপনির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই বাজি ধরছেন অনেকে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার এক প্রতিবেদনে বলছে, উপনির্বাচনে জেতা আসনেও জয় পাওয়া যে কঠিন, সে অভিজ্ঞতা রয়েছে বিজেপির। ২০১৯ সালে বিজেপির রাজ্য সভাপতি স্বয়ং দিলীপ ঘোষের খড়গপুর সদরও তৃণমূলের কাছে হারাতে হয়েছিল গেরুয়া শিবিরকে। আর ভবানীপুরে গত বিধানসভা নির্বাচনে তো বড় ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল। তার ওপর উপনির্বাচনে আবার প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোট পরার হারও সন্তোষজনক নয়। তাই জেতার আশা নয়, বরং কত ভোটের ব্যবধানে পরাজয় সেই অঙ্কই কষছে বিজেপি শিবির।

রোববার ভবানীপুরের সঙ্গে নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতে চলা শামসেরগঞ্জ কিংবা জঙ্গিপুর নিয়েও আশাবাদী নয় বিজেপি। কারণ মুর্শিদাবাদে না আছে সংগঠন, না ছিল হাওয়া। ফলে রোববারের ফল যে ৩-০ হতে চলেছে তার জন্য অন্তত মানসিকভাবে প্রস্তুত বিজেপি।

আর মমতার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল প্রচারপর্বে নিজেকে ‘লড়াকু’ হিসেবে তুলে ধরলেও ফল ঘোষণার আগের দিন একেবারেই চুপ। আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘আমি ফল নিয়ে ভাবছি না। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন অন্য কাজে ব্যস্ত রয়েছি।’ প্রিয়াঙ্কা ‘অন্য কাজ’-এ ব্যস্ত থাকলেও বিজেপি শিবিরের একাংশ হিসেব কষছেন পরাজয়ের ব্যবধান নিয়ে। রাজ্য নেতাদের প্রায় সকলেই মনে করছেন বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় উপনির্বাচনে জয়ের ব্যবধান বাড়িয়ে নেবে তৃণমূল। মমতা জিততে পারেন ৩০ থেকে ৪০ হাজার ভোটে।

ভোট প্রচারে যাই বলা হোক না কেন ভবানীপুর যে দলের জন্য কঠিন ঠাঁই, তা মানছেন রাজ্য নেতারা। এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, ‘আসলে উপনির্বাচন যখন রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় কোনও পরিবর্তন আনতে পারবে না বলে বোঝা যায়, তখন সাধারণ ভোটাররা চিন্তা কম করেন। এমনকি ভোট দিতেও সেভাবে আগ্রহ দেখান না। সেটা পরিসংখ্যানই বলে দেয়।’

এই বক্তব্য যে অনেকাংশেই ঠিক, তার উদাহরণ আগেই দেখিয়েছে ভবানীপুর। ২০১১ সালেও এই আসনে উপনির্বাচনে জিতেছিলেন মমতা। সে বার নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সী যখন জিতেছিলেন, তখন এই আসনে ভোট পড়েছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭৪১টি। যা মোট ভোটারের ৬৩.৭৮ শতাংশ। পরে মুখ্যমন্ত্রী যখন উপনির্বাচনে প্রার্থী হলেন, তখন সেটা কমে হয়ে যায় ৯৫ হাজার ৬৪; অর্থাৎ ৪৪.৭৩ শতাংশ। মানে ১৯.০৪ শতাংশ কম।

আবার ২০১৬ সালে মমতা যখন জিতলেন তখন ভোট পড়ে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭৫। যা মোট ভোটারের ৬৬.৮৩ শতাংশ। গত এপ্রিল মাসে তৃণমূলের শোভন দেব চট্টোপাধ্যায় যখন জিতলেন, তখন ভোট পড়েছিল ১ লাখ ২৭ হাজার ৫৩৬। মানে ৬১.৭৯ শতাংশ। আর এবার পড়েছে ৫৭ শতাংশের একটু বেশি।

বিজেপি নেতারা মুখে না বললেও একান্ত আলোচনায় স্বীকার করছেন, প্রচারে উত্তাপ ছড়ানো গেলেও ভবানীপুরে ভোট করাতে পারেনি দল। বহুতলের বাংলাভাষী নন এমন বাসিন্দাদের ভোটের লাইনে দাঁড় করিয়ে জয় পেতে চেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। দলটির এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘ভবানীপুর এলাকায় একটা বড় অংশের মুসলিম ভোটার রয়েছেন। তাদের ভোট ইভিএম বন্দি হলেও হিন্দু ভোটকে সেভাবে একত্রিত করা যায়নি। ফলে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান বাড়তে পারে। শোভন দেব জিতেছিলেন ২৮ হাজার ৭১৯ ভোটে। এবার মমতা তা টপকে যেতে পারেন।’

হার নিশ্চিত জেনেও রোববার কী বলা হবে, তার মহড়াও করে রেখেছে বিজেপি। ভোট গ্রহণের দিন থেকেই গেরুয়া শিবির বলতে শুরু করে, মুখ্যমন্ত্রীর জয় নিশ্চিত করতে কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে তৃণমূল। অন্য দিকে, শাসকদল জয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে স্লোগান তুলেছে, ‘বি ফর ভবানীপুর, বি ফর ভারত’। এর পাল্টায় বিজেপির এক নেতা বলেন, ‘তৃণমূল ওটা বললে আমরাও ঠিক করে রেখেছি কী বলব। আমাদের স্লোগান হবে ‘বি ফর ভবানীপুর, বি ফর বাঁশদ্রোণী’। কারণ, ভবানীপুরে আমরা হাতেনাতে বাঁশদ্রোণী থেকে আসা ভুয়া ভোটার ধরেছি।’

এসএস