ভাগ্যাহত শরণার্থীদের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা আর তাদের জীবনে ঔপনিবেশিকতার প্রভাব নিজের লেখনীতে দ্ব্যর্থহীনভাবে ফুটিয়ে তুলে সাহিত্যে চলতি বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তানজানিয়ার ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ। সাহিত্যে ১১৮তম নোবেল বিজয়ী হিসেবে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি গত বৃহস্পতিবার তার নাম ঘোষণা করে।

সুইডিশ একাডেমি বলেছে, আব্দুলরাজাক গুরনাহর আপোষহীন ও দরদী লেখায় ঔপনিবেশিকতার দুর্দশা আর শরণার্থীদের জীবনের নানা কষ্ট-ব্যঞ্জনার গল্প ফুটে উঠেছে।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ ১৯৪৮ সালে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আফ্রিকার জাঞ্জিবার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। গত শতাব্দীর ৬০ এর দশকের শেষের দিকে শরণার্থী হিসেবে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান তিনি। ৭২ বছর বয়সী গুরনাহ এখন ব্রিটেনেই থাকেন। পঞ্চম আফ্রিকান লেখক হিসেবে সাহিত্যে এই পুরস্কারটি পেলেন তিনি।

তবে গুরনাহর সাহিত্যে নোবেলপ্রাপ্তি ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তানজানিয়ায়। অনেকেই শরণার্থী জীবনের গল্প লিখে গুরনাহর সাহিত্যে নোবেল জয়কে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে উদযাপন করলেও তানজানিয়ায় তার পরিচয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

নোবেল পুরস্কারে কৃষ্ণাঙ্গ ও নারীদের সংখ্যার অভাব কেন, এই বিতর্কও নতুন করে দানা বেঁধেছে। তার মধ্যেই গুরনাহর এই অর্জন। এখানে বলে নেওয়া ভালো, দক্ষিণ আফ্রিকার জন এম কোয়েটজি ২০০৩ সালে এবং সেখানকারই নাদিন গোর্ডিমার ১৯৯১ সালে সাহিত্যে নোবেল পান। তার আগে, মিশরীয় লেখক নাগিব মাহফুজ ১৯৮৮ সালে এবং নাইজেরীয় ওলে সোয়িঙ্কা ১৯৮৬ সালে নোবেল পান।

কিন্তু চার জনের মধ্যে একমাত্র ওলে সোয়িঙ্কা ছাড়া কেউই কৃষ্ণাঙ্গ নন। সোয়িঙ্কাই সাব-সাহারান (সাহারা মরুভূমির দক্ষণের ভূখণ্ড) আফ্রিকার প্রথম সাহিত্যে নোবেলজয়ী। কোয়েটজি ডাচ বংশোদ্ভুত এবং তার পূর্বপুরুষরা সপ্তদশ শতাব্দীতে সম্ভবত শরণার্থী হিসেবে আফ্রিকায় আসেন। গোর্ডিমাররাও শরণার্থী, রাশিয়া থেকে যাওয়া। আফ্রিকান হিসেবে সাহিত্যে প্রথম নারী নোবেলজয়ীও এই গোর্ডিমার।

১৯৪৮ সালের ২০ ডিসেম্বর জাঞ্জিবারে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুলরাজাক গুরনাহ। জাঞ্জিবার এখন তানজানিয়ার অংশ হলেও তখন এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন ভূখণ্ড। জার্মানির সঙ্গে এলাকা ভাগাভাগিতে এই অংশটি পেয়েছিল ব্রিটিশরা। ১৮৯০ সালে হেলিগোল্যান্ড-জাঞ্জিবার চুক্তির ফলে এই ভাগাভাগি হয়।

কৃতদাসের বাজারের জন্য জাঞ্জিবার এক সময় প্রসিদ্ধ ছিল, পৃথিবীর সর্বশেষ উন্মুক্ত কৃতদাসের বাজার ছিল এখানেই। ১৮৭৩ সালে যা ব্রিটিশরা বন্ধ করে দেয়। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশরা এই এলাকা ছেড়ে যায়। ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে জাঞ্জিবার ক্রমে তানজানিয়াভুক্ত হয়।

এই অবস্থায় ১৯৬৮ সালে গুরনাহ স্বদেশ ছেড়ে চলে যান ব্রিটেনে। তখন তার বয়স ২০ বছর। নিরাপত্তার স্বার্থে ব্রিটেনে গেলেও ১৯৮৪ পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। ইউরোপের এই দেশে থেকেই পড়াশোনা, অধ্যাপনা, নোবেলপ্রাপ্তি আর ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ার।

আব্দুলরাজাকের মাতৃভাষা সোয়াহিলি। এই ভাষাটি তানজানিয়াসহ পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার বহু মানুষের মাতৃভাষা। রাজাক ২১ বছর বয়সে ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেন। কর্মজীবনে হন ইংরেজির অধ্যাপকও। ইউনিভার্সিটি অব কেন্ট থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন।

নোবেল ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে, তার শিক্ষাসময়ের কাজেও উপনিবেশ-পরবর্তী, অভিবাসীদের নিয়ে অনেক কিছুই রয়েছে। সালমান রুশদি, সোয়িঙ্কাদের সারিতেই তাকে ফেলা যায়। কসমোপলিটান শহর জাঞ্জিবারের মতোই আরবি, হিন্দি, জার্মান ভাষার নানা প্রকাশভঙ্গি তাই সহজেই ঢুকে পড়েছে রাজাকের লেখায়।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ এখন পর্যন্ত দশটি উপন্যাস লিখেছেন। রয়েছে অনেক ছোট গল্প এবং প্রবন্ধ। ডিপার্চার (১৯৮৭), পিলগ্রিমস ওয়ে (১৯৮৮), প্যারাডাইস (১৯৯৪), বাই দ্য সি (২০০১), ডিসার্শন (২০০৫), গ্র্যাভেল হার্ট (২০১৭) এবং সর্বশেষ উপন্যাস আফটার লাইভস উল্লেখ করা যেতে পারে।

শরণার্থীদের অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতি হারানোর টানাপোড়েন রয়েছে তার লেখা জুড়ে। বেশিরভাগ উপন্যাসে মূল চরিত্র হয়ে উঠেছে কোনো আফ্রিকান আরব, যে চরিত্র বাড়ি-ঘর হারিয়ে নতুন এলাকায় গিয়ে নতুন সংস্কৃতিকে কী ভাবে দেখছে, খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে চলেছে নব-অবস্থানে, তারই বর্ণনা।

আব্দুলরাজাকের প্যারাডাইস উপন্যাসটি বুকার পুরস্কারের জন্য ছোট তালিকায় ছিল। ওই উপন্যাসের মূল চরিত্র ইউসুফ নামে একটি শিশু। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তানজানিয়ার ছোট শহর কাওয়ায় তার জন্ম হয়। ইউসুফের বাবা ঋণে জর্জিত হয়ে আজিজ নামে এক আরব ব্যবসায়ীর কাছে বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য হয়।

আরব ব্যবসায়ী আজিজের ক্যারাভানে ইউসুফ মধ্য আফ্রিকা, কঙ্গো অববাহিকায় ঘুরতে থাকে। নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় সে। পূর্ব আফ্রিকায় ক্যারাভ্যান ফিরে যখন এলো, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু। তানজানিয়ায় জার্মান সেনাদের তাণ্ডব চলছে। জার্মানরা অফ্রিকান পুরুষদের জোর করে তাদের সেনাবাহিনীতে ঢোকাচ্ছে। আজিজের ক্যারাভ্যান জার্মান সেনাবাহিনীর হাতে পড়ে গেল সে সময়।… এক আশ্চর্য স্মৃতি-চেরা মায়াবি ভাষায় এর কাহিনী লিখে যান গুরনাহ।

এছাড়া ২০০৪ সালের রাইটিং অ্যান্ড প্লেস নামক একটি প্রবন্ধে গুরনাহ লিখেছেন, ‘… যখন আমি বাড়ি ছেড়েছিলাম, আমার লক্ষ্য ছিল সহজ-সরল। সেটি কঠিন লড়াইয়ের সময়। রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে মাথা গোঁজার লক্ষ্য ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ডে লেখালিখি করার কথা ভাবতে লাগলাম। সেই লেখা হবে অন্য রকম।…’

‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার কাজে অবাক হয়ে থেমে গেলাম। তার পর বুঝতে পারলাম আমি নিজের স্মৃতি থেকে লিখছি। কী উজ্জ্বল সেই স্মৃতি। ইংল্যান্ডে বসবাসের প্রথম বছরগুলোতে যে হালকা অস্তিত্ব ছিল আমার, তার থেকে যেন বহু দূরে চলছিল লেখালিখি।… বিগত জীবনটা নিয়ে আমি লিখবো ঠিক করে ফেলি, হারানো জায়গা, যা আমার স্মৃতিতে আছে, তাই আমার লেখায় এসেছে।’

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে নিজের নাম ঘোষিত হওয়ার পর অতীত স্মরণ করে গুরনাহ বলেন, ব্রিটেনে যাওয়ার জন্য মাত্র এক মাসের পর্যটক ভিসা পেয়েছিলেন তিনি; যা তাকে ব্রিটেন ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়।

সেখানে পৌঁছানোর পর দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের ক্যান্টারবুরির একটি টেকনিক্যাল কলেজে এ-লেভেলে পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে পড়াশোনা, অধ্যাপনা আর নোবেলপ্রাপ্তি।

টিএম