দুবাই সরকার এবং জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন অবকাঠামো নির্মাণ সম্পর্কিত একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। যেহেতু জম্মু ও কাশ্মির ইস্যুটি সবসময়ই একটি বিতর্কিত বিষয়, তাই এ চুক্তি স্বাক্ষরকে আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।  

পাকিস্তানের কূটনীতিকরা বলছেন যে, এটা পাকিস্তানের জন্য একটা বড় ধাক্কা। দুবাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্তর্গত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি ইসলামিক দেশ। ইসলামের বিষয়টা সামনে রেখে পাকিস্তান কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে, এতে এখনও পর্যন্ত কার্যত কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি দেশটি। এ ইস্যুতে খোলাখুলিভাবে কেবল তুরস্কই পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে, বাকিরা দেশটিকে হতাশই করেছে।  

৩৭০ ধারা বিলুপ্ত হওয়ার পরেও সংযুক্ত আরব আমিরাত পাকিস্তানের সমর্থনে দাঁড়ায়নি। এখন বলা হচ্ছে যে, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার পরে কাশ্মিরের সঙ্গে দুবাইয়ের এই চুক্তিকে, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে কাশ্মিরকে স্বীকৃতি দেওয়ার সমতুল্য। এটাকে পাকিস্তানের জন্য কৌশলগত একটা ধাক্কা হিসাবে দেখা হচ্ছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় সোমবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে যে, এই চুক্তির আওতায় দুবাই সরকার জম্মু ও কাশ্মিরের রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করবে; যার মধ্যে রয়েছে শিল্প পার্ক, আইটি টাওয়ার, মাল্টিপারপাস টাওয়ার, লজিস্টিক, মেডিকেল কলেজ, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল।

তবে চুক্তির আওতায় এসব অবকাঠানো নির্মাণে খরচ কেমন হবে সেটা সম্পর্কে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কিছু বলা হয়নি।  

সংবাদ সংস্থা রয়টার্স বলছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের অংশ দুবাই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং জম্মু ও কাশ্মির বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার এবং এটিকে দুটি  কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করার পর এটা বিদেশি সরকারের প্রথম বিনিয়োগ চুক্তি।

বিবৃতিতে কী বলা হয়েছে?
কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযুষ গোয়েল এক বিবৃতিতে বলেছেন, দুবাই সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরে প্রমাণ হয়েছে যে, বিশ্ব স্বীকৃতি দিচ্ছে- জম্মু ও কাশ্মির উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সামিল হয়েছে। 

‘এই সমঝোতা স্মারক গোটা বিশ্বকে এ বার্তা দিচ্ছে যে ভারত বিশ্বশক্তিতে পরিণত হচ্ছে এবং এতে জম্মু ও কাশ্মিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।’ 

পীযুষ গোয়েল বলছেন যে, এই সমঝোতা স্মারক একটা মাইলফলক। এর পরে সারা বিশ্ব থেকে বিনিয়োগ আসবে এবং এটা একটা বড় সুযোগ তৈরি করবে। দুবাইয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্র ইতোমধ্যে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে এবং সব দিক থেকে প্রবৃদ্ধির আশা রয়েছে। আমরা সঠিক পথে আছি।
 
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে গোয়েল বলেন, তিনি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মিরের উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ২৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার সাম্প্রতিক শিল্প প্যাকেজ এই উন্নয়নের ধারার প্রমাণ। 

জম্মু ও কাশ্মিরের উপ-রাজ্যপাল মনোজ সিনহাও এটাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে এটা শিল্পায়ন এবং টেকসই উন্নয়নে জম্মু ও কাশ্মিরকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সহায়তা করবে।

তবে রয়টার্স লিখেছে যে, এই অঞ্চলে সবসময়ই সেনাবাহিনী মোতায়েন করে রাখা হয়। এখানে বিনিয়োগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আবার সাম্প্রতিক সময়ে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বেশ কয়েকটি চরমপন্থি হামলা হয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে, যার ফলে অনেক লোক নিহত হয়েছে।

একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের পর সোমবার ভারতীয় প্রশাসন হাজারো অভিবাসী শ্রমিককে নিরাপদ স্থানে নিতে বাধ্য হয়। তবে তার আগেই শত শত শ্রমিক কাশ্মির ছেড়ে চলে গেছে। 

পাকিস্তানের প্রাক্তন কূটনীতিকরা কী বলছেন?
ভারত সরকার এটাকে বড় একটা সাফল্য হিসাবেই দেখছে। অন্যদিকে পাকিস্তানও এই ঘটনার দিকে নজর রাখছে। কারণ দুই দেশই কাশ্মিরকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে আসছে।

চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণার পর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলা হয়নি, তবে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি এই ইস্যুতে একটি টুইট করেছেন।

ভারত-শাসিত কাশ্মিরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এনে টুইটে তিনি লিখেছেন, ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসবাদ এবং নৃশংস সামরিক অবরোধ কাশ্মিরি জনগণের স্বাধিকারের জন্য লড়াই করার ইচ্ছা ভাঙতে পারবে না। পাকিস্তান তাদের (স্বাধীনতাকামীদের) উদ্দেশ্যকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। 

ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাই কমিশনার আব্দুল বাসিতও দুবাইয়ের সাথে এই চুক্তিকে ভারতের জন্য একটা বড় সাফল্য হিসেবেই মনে করছেন। 

তিনি বলেন, ভারত সবসময় অন্যান্য দেশকে জম্মু ও কাশ্মিরে তাদের মিশন এবং হাই কমিশন খুলতে ও সেখানে বিনিয়োগ করতে রাজি করানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এটার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসিতে কাশ্মির ইস্যুকে দুর্বল করা। 

 ইউটিউবে একটি ভিডিওতে আব্দুল বাসিতকে বলতে শোনা যাচ্ছে, দুবাই ভারতে বিনিয়োগের জন্য যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেটা কেবল সমঝোতা স্মারক হওয়ায় এ নিয়ে খুব বেশি তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। জম্মু-কাশ্মির ও পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে এটা ভারতের জন্য একটা বড় সাফল্য। 

‘মুসলিম দেশ এবং ওআইসির সদস্য দেশগুলো সবসময় পাকিস্তান এবং কাশ্মির ইস্যুকে গুরুত্বের সঙ্গেই দেখে থাকে এবং তারা সবসময়ই ভাবে যে তাদের কোনো কাজে যেন এমন মনে না হয় যে তারা পাকিস্তানের সাথে নেই।’ 

‘এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে এই কাশ্মির ইস্যুটা আমাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা অন্ধকারে হাত-পা ছুড়ছি এবং সত্যটা হলো যে, কাশ্মির নিয়ে আমাদের আর কোনো নীতি নেই। বর্তমান সরকারের কাশ্মির নিয়ে ঢিলেঢালা মনোভাব রয়েছে, যা ভবিষ্যতে তাদের জন্য চিন্তার কারণ হবে। অবশ্য আগের সরকারগুলোও আমাদের কাশ্মির নীতিকে দুর্বল করতে কোনো কিছু বাদ রাখেনি।’

আব্দুল বাসিত আরও বলছেন যে, ভারত এবং পাকিস্তান দুই দেশের জন্যই কাশ্মির সমস্যার সমাধান হওয়া জরুরি। এখন প্রশ্ন হলো পাকিস্তান কি একতরফা সব ছাড় দেবে? 

‘এখন তো সবেমাত্র সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সামনে তো এমনও হতে পারে যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান কাশ্মিরে তাদের কনস্যুলেট খুলবে। যদি আমাদের কূটনীতির এই অবস্থা থেকে যায়, তবে ভবিষ্যতে যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।’ 

এর সাথে বাসিত আফগানিস্তান নিয়ে পাকিস্তানের কূটনীতি প্রসঙ্গেও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলছেন, এক সময় পাকিস্তানকে আফগানিস্তান ইস্যুতে সফল বলে মনে হয়েছিল, তবে এখন তারা চাপের মুখে পড়েছে।

‘আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন দূত জালমে খলিলজাদ পদত্যাগ করেছেন এবং মস্কো ফোরামে যুক্তরাষ্ট্র থাকছে না। কিন্তু সেখানে তালেবান এবং ভারত থাকবে। তালেবানদের স্বীকৃতির বিষয়টিরও সুরাহা হচ্ছে না, আবার পাকিস্তানও এ বিষয়ে কিছু করা বন্ধ করে দিয়েছে।’ 

‘পাকিস্তান কোনো ইস্যু নিয়ে এগোতে পারছে না। আমরা জম্মু -কাশ্মির নিয়ে বেশ কিছু নথি দিয়েছিলাম, কিন্তু তাতে কী হলো, মনে হলো এসব কথা কেউ শুনলোই না। সেটা নিয়ে কোনো কাজই হলো না। ফলোআপে আমরা খুবই দুর্বল আর সেটাই আমাদের আসল সমস্যা। তা না হলে কাশ্মির, আফগানিস্তান এবং চীন নিয়ে আমরা যা চাই, তা না পারার কোনো কারণ নেই।’ 

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূমিকা
মুসলিম দেশগুলো ওআইসিতে কাশ্মির ইস্যু তোলে ঠিকই, একইসঙ্গে তারা এর শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষেও কথা বলে আসছে।

এ বছরের শুরুতে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়, তখন সংযুক্ত আরব আমিরাত এগিয়ে এসে দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।   

এ বছরের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ আল-ওতাইবা বলেছিলেন, আমিরাত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

রয়টার্স জানিয়েছে, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভার্চুয়াল এক আলোচনায় ওতাইবা বলেন, জানুয়ারিতে দুবাইয়ে ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা বৈঠক হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত কাশ্মিরে উত্তেজনা কমাতে ও সংঘর্ষে বিরতি টানতে ভূমিকা রাখে। আশা করি সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

‘তাদের সম্পর্ক খুব নিবিড় হয়তো হবে না, কিন্তু আমরা চাই সম্পর্কটা অন্তত এমন হোক যেখানে দুই দেশ আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে।’ 

অনুবাদ: নাঈম ফেরদৌস রিতম। 

এনএফ