অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা নেওয়ার পর ইউরোপে যে কয়েকজন মানুষের রক্তজমাট বেঁধেছিল, তার মূল কারণ উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানীর গবেষণায় জানা গেছে এ প্রশ্নের উত্তর। চিকিৎসা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে সেই গবেষণা প্রতিবেদন।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার মূল উপাদান হলো সার্স-কোভ-২ বা করোনাভাইরাসের সমধর্মী কোনো ভাইরাস (অ্যাডেনোভাইরাস), যেটির অভ্যন্তরে করোনাভাইরাসের জেনেটিক বৈশিষ্টগুলো বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করানো হয়েছে। অর্থাৎ এটি এক প্রকার রূপান্তরিত অ্যাডেনোভাইরাস; যা মানুষের প্রতিরোধী শক্তিকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করে।

অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে যে অ্যাডেনোভাইরাসটি বেছে নিয়েছে, সেটি একটি সাধারণ ঠাণ্ডাজ্বর সৃষ্টিকারী একপ্রকার ভাইরাস। মানুষ ও শিম্পাঞ্জি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।

এতদিন বিজ্ঞানীদের একাংশের সন্দেহ ছিল, মূল সমস্যা রয়েছে অ্যাডেনোভারাসের মধ্যে। সম্ভবত কিছু মানুষের দেহের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের সঙ্গে এই ভাইরাসটি খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না এবং তারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে এই রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া। কিন্তু ল্যানসেটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা অ্যাডেনোভাইরাসের মধ্যে কোনো সমস্যা দেখতে পাননি।

সেক্ষেত্রে কী কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে—প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মানবদেহে এই টিকার ডোজ প্রবেশ করার পরপরই রক্তে প্ল্যাটিলেট-৪ নামের এক প্রকার অনুচক্রিকার নিঃসরণ ঘটতে শুরু করে।

টিকার অ্যাডেনোভারাসের মধ্যে রয়েছে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রতিরোধী উোদান, অন্যদিকে প্ল্যাটিলেট-৪ ব্যাপকভাবে ইতিবাচক প্রতিরোধী উপাদানে সমৃদ্ধ। এই নেতিবাচক ও ইতিবাচক প্রতিরোধী উপাদানের সম্মিলনের ফলেই মানবদেহে তৈরি হয় করোনা প্রতিরোধী শক্তি বা প্রোটিন।

প্রায় সব মানুষের দেহে এই সম্মিলন নির্বিঘ্নে হলেও বিরল কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, টিকার ডোজ মানবদেহে প্রবেশের পর নিঃসৃত প্ল্যাটিলেট-৪ যখন অ্যাডেনোভাইরাসের সামনে আসে, তখন তাকে ভুলক্রমে প্রতিপক্ষ ভাইরাস ভেবে আক্রমণ করে অ্যাডেনোভাইরাস। তখন এই দুইয়ের সম্মিলনের পরিবর্তে শুরু হয় যুদ্ধ এবং তার ফলেই রক্ত জমাট বাঁধার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

চলতি বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে ইউরোপে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার ডোজ নেওয়ার পর রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার সমস্যায় আক্রান্ত হন দুই শতাধিক ব্যক্তি, তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১০০ জনের বেশি। শুধু যুক্তরাজ্যেই এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭৩ জন।

কিন্তু একই সঙ্গে এটিও সত্য, বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ নিয়েছেন অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা। তারা জটিল কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হননি। কেবল যুক্তরাজ্যের টিকাদান কর্মসূচিতেই ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ৫ কোটি অ্যাস্ট্রাজেনেকার ডোজ।

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ও কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অ্যালেন পার্কার বিবিসিকে বলেন, ‘টিকা নেওয়ার পর কারও দেহে এই সমস্যা দেখা দেবে তা আগে থেকে বলার কোনো উপায় নেই এবং বিশ্বজুড়ে যতসংখ্যক অ্যাস্ট্রাজেনেকার ডোজ ব্যবহৃত হয়েছে; সেই তুলনায় রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা খুবই, খুবই কম।’

‘এ কারণে এই সমস্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং টিকাটি যে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে করোনা থেকে সুরক্ষা দিয়েছে এবং দিচ্ছে; সেই বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

এসএমডব্লিউ