নাগাল্যান্ডের প্রত্যন্ত এলাকায় দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ক্যাম্পে পাথর নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ করেছেন বিক্ষোভকারীরা

প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভুল অভিযানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য নাগাল্যান্ডে ১৪ জন বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানির পর ওই অঞ্চলে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়েছে। শনিবার রাতের ‌‘তথাকথিত’ অভিযানে হতাহতের ঘটনার পর রোববার ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে ফের সংঘাতে জড়িয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়েছেন বলে দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, রোববার ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ক্যাম্পে পাথর নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ জনগণ। নতুন করে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তাবাহিনীর ছোড়া গুলিতে ফের একজন বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছে।

এর আগে, শনিবার রাতে নাগাল্যান্ড রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ভুল অভিযানে ১৪ বেসামরিক নাগরিক নিহত ও অনেকে আহত হন। ওই সময় আইনশৃঙ্খলবাহিনীর এক সদস্যও নিহত হয়েছেন। নাগাল্যান্ডে একদল শ্রমিককে ভুলে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ মনে করে গুলি চালালে হতাহতের এই ঘটনা ঘটে।

নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এই ঘটনা ও পরবর্তী সহিংসতায় এক ডজনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন।’

 নাগাল্যান্ডে বিক্ষুব্ধ স্থানীয়দের ধরিয়ে দেওয়া আগুনে পুড়ছে আইনশৃঙ্খলবাহিনীর যানবাহন

দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠীর সদস্যদের নিহত হওয়ার খবরে তিনি ‘ব্যথিত।’ নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেইফিউ রিও রয়টার্সকে বলেছেন, তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে।

ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় দেশটির উপজাতি বিভিন্ন গোষ্ঠীর আবাসস্থল রয়েছে; যাদের অনেকেই নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে সম্পদ লুণ্ঠন এবং তাদের জীবনমানের উন্নতির জন্য তেমন কিছুই করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে। উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর অনেকে নয়াদিল্লির শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহ করে আসছে।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানের সময় বারবার নির্দোষ স্থানীয়দের ভুল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে বলে অভিযোগ করছে নাগাল্যান্ডের জনগণ। রোববার নাগাল্যান্ডের মন জেলায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু করেছে রাজ্যের বেসামরিক জনগণ; যেখানে ১৪ উপজাতিকে হত্যা করা হয়েছে।

মন জেলার আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয়রা অবস্থান নিয়েছে। তারা ক্যাম্প লক্ষ্য করে ইট-পাথর নিক্ষেপ করছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ক্যাম্প বিক্ষোভকারীরা ঘিরে ফেলেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

নিরাপত্তা বাহিনীর ভুল অভিযানের পেছনে গোয়েন্দা ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেইফিউ রিও

নাগাল্যান্ডের শিক্ষার্থীদের সংগঠন কন্যাক স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতি নোকলেম কন্যাক টেলিফোনে রয়টার্সকে বলেছেন, মন শহরে কিছুক্ষণ আগে আসাম রাইফেলসের গুলিতে একজন বেসামরিক নিহত ও আরও দু’জন আহত হয়েছেন। মন জেলার প্রভাবশালী উপজাতি একটি গোষ্ঠী হলো কন্যাক।

সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের সামরিক বাহিনী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মন্তব্য জানা যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

কী ঘটেছে নাগাল্যান্ডে?

নাগাল্যান্ড পুলিশের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মিয়ানমার সীমান্ত লাগোয়া মন জেলার ওটিং গ্রাম ও এর আশপাশের এলাকায় শনিবার রাতে ভারতের প্রাচীন আধা-সামরিক বাহিনী আসাম রাইফেলসের সদস্যদের বিদ্রোহীবিরোধী অভিযানের সময় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

৩০ অথবা তারও বেশি কয়লা খনি শ্রমিককে নিয়ে একটি ট্রাক আসাম রাইফেলসের ক্যাম্প অতিক্রম করে যাওয়ার সময় গোলাগুলি শুরু হয়। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সৈন্যদের কাছে ওই এলাকায় কিছু বিদ্রোহীর চলাচলের ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য ছিল এবং ট্রাকটি দেখে ভুলেই খনি শ্রমিকদের ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে মনে করেন সৈন্যরা। এ সময় ট্রাক লক্ষ্য করে গুলি চালালে ছয়জন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে।

তিনি বলেন, ‘গুলি চালানোর এই খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার পর শত শত উপজাতি লোকজন ওই ক্যাম্প ঘিরে ফেলেন। তারা আসাম রাইফেলসের যানবাহন পুড়িয়ে দেন এবং দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সৈন্যদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন।’

পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসাম রাইফেলসের সদস্যরা পাল্টা গুলি চালান। দ্বিতীয় হামলায় আট বেসামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য নিহত হয়েছেন।

নাগাল্যান্ডের প্রভাবশালী মানবাধিকার সংস্থা দ্য নাগা মাদারস এসোসিয়েশন (এনএমএ) বেসামরিক নাগরিক নিহতের ঘটনায় সকল নাগা উপজাতিকে শোক পালনের আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে বেসামরিক এলাকা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি তুলেছে সংস্থাটি।

এনএমএর প্রেসিডেন্ট আবেইউ মেরু বলেছেন, ‘বিশ্বকে আমাদের শোক এবং দুঃখ জানান। সশস্ত্র বাহিনী ক্ষমতা আইনের আওতায় অব্যাহত সামরিকীকরণ এবং হত্যার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদের আওয়াজ তুলুন।’

বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানের সময় বারবার নিরপরাধ স্থানীয়দের ভুল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার অভিযোগ উঠেছে

ওই আইনে ‘অশান্ত এলাকা’ হিসাবে ঘোষিত দেশের কিছু অংশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় মনে করলে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ‌তল্লাশি, গ্রেফতার এবং গুলি চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

নাগাল্যান্ডের কিছু অংশকে গত বছর দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার ‘অশান্ত এলাকা’ হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। সোমবার মৃতদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তার আগে ওই এলাকায় পুলিশ, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের টহল জোরদার করা হয়েছে।

গত কয়েক বছরে নাগাল্যান্ড, মনিপুর এবং অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ঘন জঙ্গলের ঘাঁটিগুলো থেকে বিদ্রোহীদের উচ্ছেদে মিয়ানমারকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছে ভারত।

সূত্র: রয়টার্স, এনডিটিভি।

এসএস