সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন দেশটির ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান নেতা অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ অনেকে। সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচন নিয়ে বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান টানাপোড়েনের মধ্যেই তাদের আটক ও সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটল।

সু চির জীবনে উত্থান-পতনের চিত্র অনেক। দীর্ঘ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার কারণে অং সান সুচিকে যেমন বলা হতো ‘মানবাধিকারের বাতিঘর’, তেমনি রোহিঙ্গা নির্যাতন, গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কোনো কথা না বলায় অন্তর্জাতিক পর্যায়ে হয়েছেন সমালোচিত। সম্মানের চূড়া থেকে নেমেছেন মাটিতে, হয়েছেন তীব্র সমালোচনার শিকার। এমনকি তার নোবেল শান্তি পুরস্কারও ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন মহল থেকে।

এক নজরে সু চির জীবনের উত্থান-পতনের গল্প: 

১৯ জুন, ১৯৪৫: মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সানের মেয়ে অং সান সু চি। ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন ইয়াঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার যখন দুই বছর বয়স তখন তার বাবাকে হত্যা করা হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র দুই বছর পর এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।

১৯৮৮: মৃত্যু শয্যায় থাকা মাকে দেখতে দেশে ফিরে আসেন সু চি। এসময় দীর্ঘ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মানুষের বিক্ষোভে সমর্থন দেন তিনি।

১৯৮৯: হাজার হাজার মানুষকে হত্যা ও বিক্ষোভ দমনের পর সু চিকে গৃহবন্দী করে সামরিক বাহিনী।

১৯৯১: ইয়াঙ্গুনে নিজের বাড়িতে বন্দী থাকার সময় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

১৯৯৫: এই বছর অং সান সু চিকে গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর থেকেই বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া জনতার উদ্দেশে নিয়মিতই ভাষণ দিতেন তিনি।

১৯৯৯: ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সু চির স্বামী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল অরিস মারা যান। কিন্তু সু চি তাকে দেখতে মিয়ানমার ত্যাগ করেননি। সামরিক জান্তা সরকার তার দেশে ফেরা আটকে দিতে পারে; এমন আশঙ্কায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।

২০০০: ১৯ মাসের জন্য আবারও তাকে বন্দী করা হয়।

২০০৩: সামরিক শাসনপন্থীরা এ বছর অং সান সু চির ওপর হামলা করে। এতে তার কয়েকজন সমর্থক নিহত হন।

২০০৭: জ্বালানি তেলের নাটকীয় মূল্য বৃদ্ধির পর দেশজুড়ে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে মানুষ। বৌদ্ধ সন্নাসীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভকে বলা হয়েছিল ‘জাফরান বিপ্লব’। সু চি এই বিক্ষোভকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। পরে সামরিক সরকার অবশ্য এই বিক্ষোভ দমন করে।

২০১০: সামরিক বাহিনী কতৃক প্রতিষ্ঠিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ২০১০ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে বিশাল জয় লাভ করে। সু চির দল ন্যাশনাল লীগ অব ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এই নির্বাচন বয়কট করে। এরপর সাবেক জেনারেল থেইন সেইনের নেতৃত্বে সরকার কাজ শুরু করে। কিছুদিন পরই সু চি কে মুক্তি দেওয়া হয়।

২০১২: ক্ষমতায় আসার পর থেইন সেইন বাক-স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া, শত শত রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি ও ধারাবাহিক সংস্কারের কাজ শুরু করায় মোটামুটি ২০১২ সাল থেকে মিয়ানমারের ওপর থেকে বেশিরভাগ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়।

এপ্রিল, ২০১২: উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতার সিদ্ধান্ত নেন অং সান সু চি। উপ-নির্বাচনে ৪৪টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৪৩টি আসন লাভ করে সু চির দল এলএনডি।

মে, ২০১২: রাজধানী নেপিদোয় মিয়ানমারের আইনসভায় নিজের আসন গ্রহণ করেন সু চি।

জুন, ২০১২: ২০১২ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বৌদ্ধ ও মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৮০ জন নিহত হয়। এসময় উভয়পক্ষের হাজার হাজার ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

নভেম্বর, ২০১৫: গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ভূমধ্বস জয় পায় সু চির দল এনএলডি। এরপর স্টেট কাউন্সিলরের দায়িত্ব নেন তিনি।

অক্টোবর, ২০১৬: রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে পুলিশ চেক পোস্টে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে ৯ পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়। এরপর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।

২৫ আগস্ট, ২০১৭: উত্তর রাখাইনে সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগে সমগ্র রাখাইনজুড়ে আবারও সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এতে  সাত লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে ও ঘরবাড়ি হারিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭: রাখাইনে সামরিক অভিযান শেষ হয়েছে বলে এদিন রাজধানী নেপিদোর এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন সু চি। তকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, পলায়নে বাধ্য করা ও মানকবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কোনো কথা না বলায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন তিনি।

১৩ নভেম্ব, ২০১৮: মানবাধিকার লঙ্ঘনে সহযোগিতা করার অভিযোগে সু চিকে ইতোপূর্বে দেওয়া মানবাধিকারবিষয়ক সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

সূত্র: রয়টার্স

টিএম