সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং স্টেট কাউন্সিলর সু চিসহ ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতাদের গ্রেপ্তারের পর সকল নজর এখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিং অং হ্লেইংয়ের ওপর। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভোরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন তিনি।

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী বেশ ‘কুখ্যাত’ হিসেবে পরিচিত এবং পর্যবেক্ষকরাও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খুব কমই জানে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই প্রভাবশালী জেনারেল এবং রাজনীতিতে তার বাহিনীর হস্তক্ষেপ সম্পর্কে কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো-

রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা
১৯৬২ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এরপর একটানা প্রায় ৫০ বছর প্রত্যক্ষভাবে দেশ শাসন করে তারা। আর তাই দীর্ঘদিন ধরেই ‘জাতীয় ঐক্যের’ অভিভাবক হিসেবে নিজেদেরকে বিবেচনা করে থাকে তারা।

এমনকি ২০০৮ সালে দেশটির সর্বশেষ সংবিধানও রচনা করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই সংবিধানের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থায়ী ভূমিকা রাখার সুযোগ করে নেয় সামরিক বাহিনী। সর্বশেষ এই সংবিধানের মাধ্যমে পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন সেনা কর্মকর্তাদের জন্য কোটা আকারে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত বিভাগে নিয়োগের দায়িত্বও দেওয়া হয় সেনাপ্রধানের হাতে। এর ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ‘বেমানান ক্ষমতা ভাগাভাগি’ করে কাজ করতে হয়েছিল সু চির এনএলডি’কে।

এছাড়া সাবেক জান্তা সরকারের কাজের বিরোধিতা করার কারণে অং সান সু চিসহ তার দলের অনেক নেতাকে অত্যাচারও সহ্য করতে হয়েছিল।

উত্থান ধীরগতির
৬৪ বছর বয়সী মিং অং হ্লেইং বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান। ২০১১ সালের ৩০ মার্চ মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে তিনি দায়িত্বগ্রহণ করেন। তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ যে অনেক বেশি তা ১৯৭২-১৯৭৪ সালে ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ার সময়ই পরিষ্কার হয়ে যায়।

২০১৬ সালে সেনাপ্রধান মিং অং হ্লেইংয়ের এক সহপাঠী বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘(বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়) তিনি খুব অল্প কথা বলতেন এবং খুব কম মানুষের সঙ্গেই মিশতেন।’

যখন অন্য ছাত্ররা তৎকালীন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় মিলিটিারি ইউনিভার্সিটি ডিফেন্স সার্ভিসেস একাডেমিতে (ডিএসএ) যোগ দিতে আবেদন করেন মিং অং হ্লেইং। প্রথম দুই দফায় সেখানে সুযোগ না পেলেও তৃতীয়বার আবেদন করে সফল হন তিনি।

ডিএসএ-তে মিং অংয়ের ক্লাসের এক সদস্য ২০১৬ সালে বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ক্যাডেট হিসেবে মোটামুটি সাধারণ মানের ছিলেন মিং অং হ্লেইং। তিনি বলেন, ‘তিনি নিয়মমাফিকই এক কোর্স থেকে পরের কোর্সে প্রমোশন পেতেন।’

২০১৫ সালে রাজধানী নেপিদোতে এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল মিং অং হ্লেইং এবং অং সান সু চি

সেনা থেকে রাজনীতিবিদ
সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তনের সময় ২০১১ সালে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন জেনারেল মিং অং হ্লেইং। ইয়াঙ্গুনে কর্মরত কূটনীতিকদের ভাষ্যমতে- ২০১১ সাল থেকে সু চি ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত সময়ে অর্থ্যাৎ ২০১৬ সালের মধ্যেই নিজেকে একজন স্বল্পভাষী সৈন্য থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেন জেনারেল হ্লেইং। এসময়ে তিনি বেশ জনপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হন।

সংবিধানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দেওয়া পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন কখনও ছাড়বেন বলে জেনারেল হ্লেইংয়ের কর্মকাণ্ডে মনে হয়নি। এমনকি সু চি-কে প্রেসিডেন্ট হওয়া থেকে সংবিধানের যে অনুচ্ছেদটি বিরত রেখেছে, সেটা পরিবর্তনেরও কোনো ইচ্ছা তার ছিল না।

২০১১ সালে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া জেনারেল মিং অং হ্লেইং ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার দায়িত্বের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বৃদ্ধি করেন।

নিষেধাজ্ঞা
২০১৭ সালে গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে সাত লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলছেন, গণহত্যা, গণধর্ষণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াসহ জাতিগত নিধনযজ্ঞ পরিচালনা করতেই রাখাইনে সামরিক অভিযান চালায় মিয়ানমার।

এরপর জেনারেল মিং অং হ্লেইংসহ আরও তিন সামরিক কর্মকর্তার ওপর ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতিসংঘ। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলাও চলছে।

এমনকি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে ২০১৯ সালে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানায় জাতিসংঘ।

সূত্র: রয়টার্স

টিএম