চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগে ১১২ জন চীনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন উইঘুর জনগোষ্ঠীর ১৯ ব্যক্তি। মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) তারা তুরস্কের একটি প্রসিকিউটর দফতরে মামলা দায়ের করেন।

মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।

তুরস্কের আইনজীবী গুলদেন সনমেজ জানিয়েছেন, সংখ্যালঘু উইঘুর জনগোষ্ঠীসহ সংখ্যালঘু অন্য আরও মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ লাখ মানুষকে ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটকে রেখেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। সেখানে তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক শ্রম আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর এই অভিযোগ সামনে আসার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চীনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি। আর এই কারণেই অভিযুক্ত চীনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করার প্রয়োজন ছিল।

চীন অবশ্য বরাবরই এ ধরনের বন্দিশিবিরের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে থাকে। তবে একপর্যায়ে এগুলোকে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে চীন দাবি করে, উগ্রবাদ দূর করতে সেখানে উইঘুর জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া উইঘুরদের ওপর গণহত্যার অভিযোগ অযৌক্তিক, হাস্যকর এবং ডাহা মিথ্যা বলেও দাবি করে থাকে বেইজিং।

তুরস্কে প্রায় ৫০ হাজার উইঘুর বসবাস করে। মধ্য এশিয়ার বাইরে এককভাবে কেবল তুর্কি ভূখণ্ডেই এতো সংখ্যক উইঘুর মুসলিমের বাস রয়েছে।

আলজাজিরা বলছে, মঙ্গলবার ইস্তাম্বুলের প্রধান প্রসিউটরের কার্যালয়ে চীনের ১১২ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন ১৯ জন উইঘুর সদস্য। তবে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে ওই প্রসিউটরের কার্যালয় থেকে বা তুরস্কে অবস্থিত চীনা দূতাবাস কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

ইস্তাম্বুলের প্রধান আদালতের বাইরে আইনজীবী গুলদেন সনমেজ জানান, ‘এই মামলার বিচারকাজ আরও আগেই শুরু করার উচিত ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের। কিন্তু চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং এ কারণে এই পন্থায় বিচার সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।’

এসময় ইস্তাম্বুলের ওই আদালতের সামনে আইনজীবীকে ঘিরে পতাকা ও প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন অর্ধশতাধিক নারী ও পুরুষ। তারা সবাই তাদের পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদের ছবি হাতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আর তাদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে অভিযুক্ত চীনা কর্মকর্তাদের বিচারের দাবি জানানো হয়।

এর আগে গত ডিসেম্বরে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর দায়ে চীনকে অভিযুক্ত করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি অনানুষ্ঠানিক স্বাধীন ট্রাইব্যুনাল। সেসময় চীনের বিরুদ্ধে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ে বলা হয়, সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন ও নিপীড়ন চালানোর মানসিকতা থেকেই চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর জন্ম নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য বাধ্যতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ চাপিয়ে দিচ্ছে। চীনা কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপকে কার্যত গণহত্যা হিসেবেই উল্লেখ করেন তারা।

এর আগে গত বছরের মার্চে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতিবেদনে জিনজিয়াংয়ে চীনা নিপীড়নের ব্যাপারে বলা হয়, ২০২০ সালে উইঘুর ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে চীনের ক্ষমতাসীন সরকার।

মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো হলো— যথেচ্ছভাবে উইঘুরদের আটক ও বন্দিশিবিরে পাঠানো, জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, শ্রমদানে বাধ্য করা এবং ধর্মপালন, মতপ্রকাশ ও চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জিনজিয়াং প্রদেশে চীন প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের আটকে রেখেছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা। এছাড়া চীনের মূলধারার হান জনগোষ্ঠীকে জিনজিয়াংয়ের কিছু এলাকায় বসবাসের জন্য স্থানান্তর করা হয়েছে।

অন্যদিকে উইঘুর শিশুদের তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

টিএম