অর্ধ-যুগের বেশি সময় ধরে ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অংশীদার হয়ে লড়াই করছে আমিরাত

ইয়েমেনে ইরান-সংশ্লিষ্ট হুথি বিদ্রোহীরা গত কিছু দিন ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে একাধিকবার ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। অর্ধ-যুগের বেশি সময় ধরে ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অংশীদার হয়ে লড়াই করছে আমিরাত।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে হামলার জবাবে এবং ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে ক্ষমতায় ফেরানোর লক্ষ্যে উত্তর ইয়েমেনের সাদা প্রদেশ ও হুথি-নিয়ন্ত্রিত রাজধানী সানায় হামলা বৃদ্ধি করেছে সৌদি জোট। সহিংসতা বৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে কী ঘটতে পারে সে সম্পর্কে চারটি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।

হুথি বিদ্রোহীরা আসলে কারা?

হুথি— সাধারণত আনসার আল্লাহ নামে পরিচিত। যারা ইয়েমেনের জাইদি শিয়া মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য। এই গোষ্ঠীর প্রতি ইরানের সমর্থন আছে বলে ধারণা করা হয়।

২০১৪ সালের গোড়ার দিকে ইয়েমেনের সাদা প্রদেশ দখলে নেওয়ার পর সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে তারা ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় সানার দিকে অগ্রসর হয়। তাদের অভিযানের মুখে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আব্দ-রাব্বু মনসুর আল-হাদি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

২০১৫ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তায় সৌদি-নেতৃত্বাধীন জোট হুথিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ক্ষমতাচ্যুত হাদি নেতৃত্বাধীন সরকারকে ইয়েমেনের ক্ষমতায় পুনরায় ফেরাতে এবং এই অঞ্চলে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে সামরিক হস্তক্ষেপ চালায় তারা।

তখন থেকে এই সংঘাতে হাজার হাজার ইয়েমেনি নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে ইয়েমেন।

প্রতিবেশি সৌদি আরবেও গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক বার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালিয়েছে হুথিরা। চলতি মাসের আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে হামলার দাবি করেছিল হুথি।

সানায় সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ দেখছেন লোকজন

ইয়েমেন যুদ্ধে আমিরাতের ভূমিকা কী?

আমিরাত-সমর্থিত বাহিনী ইয়েমেনের লোহিত সাগরের তীরবর্তী হুদাইদাহ বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হুথিদের সাথে লড়াইয়ের সময় ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে হামলা চালায় হুথি বিদ্রোহীরা। তবে ২০১৯ সালের পর থেকে ইয়েমেনে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করেছে দেশটি। তারপরও বৃহৎ স্থানীয় বাহিনীগুলোকে প্রস্তুত এবং সশস্ত্র করে গড়ে তোলার মাধ্যমে এখনও ইয়েমেনে ক্ষমতার চর্চা করেছে আমিরাত।

ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহর ভাতিজা-নেতৃত্বাধীন ইয়েমেনি যৌথবাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের (এসটিসি) প্রতি আমিরাতের সমর্থন রয়েছে।

সৌদি-নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক সহায়তায় ইয়েমেনের সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে এসটিসি। ২০১৯ সালে এই গোষ্ঠীটি ইয়েমেনের অস্থায়ী রাজধানী এডেনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

 ২০১৮ সাল থেকে আমিরাত-সমর্থিত বাহিনী ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই এড়িয়ে চলছে। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমিরাতের সেই নীতিতে পরিবর্তন দেখা গেছে।

গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে ইয়েমেনের সরকারপন্থী আমিরাত-সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠী জায়ান্টস ব্রিগেডস ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে পড়ে। ওই সময় অভিযান চালিয়ে শাবওয়াহর প্রশাসনিক এলাকা থেকে হুথিদের হটিয়ে দেয় এই ব্রিগেডস।

যৌথবাহিনীর পাশাপাশি জায়ান্টস ব্রিগেডস এখন হুথি অধ্যুষিত প্রতিবেশি আল-বায়দা এবং উত্তরাঞ্চলীয় মারিব প্রদেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইয়েমেনের কৌশলগত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর মারিব। গত কয়েক মাস ধরে এই শহর দখলের জন্য লড়াই করছে হুথি বিদ্রোহীরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জায়ান্ট ব্রিগেডস এবং আমিরাতের সামরিক সমর্থন মারিব ও শাবওয়াহতে লড়াইয়ের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। যার ফলে হুথিরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে হামলা চালাচ্ছে।

২০১৪ সালের গোড়ার দিকে ইয়েমেনের সাদা প্রদেশ দখলে নেওয়ার পর আলোচনায় আসে বিদ্রোহীগোষ্ঠী হুথি

আমিরাত-হুথিদের উত্তেজনা বৃদ্ধির সময় কী ঘটেছে?

গত ২ জানুয়ারি হুথি বিদ্রোহীরা জানায়, তারা লোহিত সাগরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পতাকাবাহী একটি জাহাজ জব্দ করেছে। এই জাহাজে করে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছিল বলে দাবি করেছে হুথিরা।

পরে গত ১৭ জানুয়ারি আবু ধাবিতে ড্রোন হামলার দাবি করে হুথি বিদ্রোহীরা। এই হামলায় আবু ধাবির একটি জ্বালানি ট্যাংকার বিস্ফোরিত হয়ে অন্তত তিনজনের প্রাণহানি ঘটে। একই দিন আবু ধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণাধীন সম্প্রসারিত স্থাপনায় হামলা চালায় হুথিরা। এতে বিমানবন্দরে নির্মাণাধীন ওই স্থাপনায় আগুন ধরে যায়।

এই হামলার জবাবে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে হুথিদের অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা জোরদার করে। সৌদি জোট বলছে, তাদের হামলার লক্ষ্য হুথি সংশ্লিষ্ট সামরিক স্থাপনা।

গত ২১ জানুয়ারি সৌদি জোটের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইয়েমেনের হাসপাতাল, টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো, বিমানবন্দর, পানি স্থাপনা এবং একটি স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে কমপক্ষে ৮০ জনের প্রাণহানি ঘটে।

একই দিনে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় সাদা প্রদেশের একটি বন্দি শিবিরে বোমা হামলা হয়। এর এক সপ্তাহ যেতে না যেতে সাদা প্রদেশে বিমান হামলায় আরও ২০ জন নিহত হন।

সংযুক্ত আরব আমিরাত গত ২৪ জানুয়ারি জানায়, আবু ধাবি লক্ষ্য করে হুথিদের ছোড়া দু’টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার পর ধ্বংস করা হয়েছে। সোমবার ইয়েমেন থেকে আবু ধাবির দিকে ছোড়া একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত এবং ধ্বংস করা হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে আমিরাত। আবু ধাবি লক্ষ্য করে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে হুথিরা। একই সঙ্গে দুবাইয়েও ড্রোন হামলা চালানোর দাবি করেছে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী।

গত ১৭ জানুয়ারি আবু ধাবিতে হুথিদের ড্রোন হামলায় জ্বালানি ট্যাংকার বিস্ফোরিত হয়ে অন্তত তিনজনের প্রাণহানি ঘটে

এরপর কী?

সহিংসতা আরও বাড়তে চলেছে। সোমবার হুথিরা বলেছে, আগামীতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক সব সংস্থার সদর দফতরকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হবে।

চলমান এই উত্তেজনায় ইয়েমেনে মানবিক সংকট আরও গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে বলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ইয়েমেনে ৫০ লাখের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন।

এছাড়া আরও ৫০ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতিতে জীবন-যাপন করছেন। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই যুদ্ধে ইয়েমেনে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। 

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো জেমস ফারওয়েল বলেন, ইয়েমেন সংঘাত অচলাবস্থায় পৌঁছেছে। সেখানে কোনও পক্ষই সামরিকভাবে জয়লাভ করতে পারেনি।

তিনি বলেন, হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের ধরন আরও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠায় সেখানকার পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ফারওয়েল বলেন, পরিস্থিতি যাতে অনুকূলে চলে আসে, সে জন্য হুথিরা সৌদি-আমিরাত জোটের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সৌদি, আমিরাত এবং হুথিরা যদি সরাসরি আলোচনায় বসে এবং একসাথে কাজ করে, তাহলে সেটিই হবে এই সংঘাতের একমাত্র সমাধান।

সূত্র: আলজাজিরা।

এসএস