পুতিন থামবেন কোথায়?
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কর্তৃক ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুটি ছিটমহলকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দান এবং ওই দুই অঞ্চলে ‘শান্তিরক্ষী’ মোতায়েনের নির্দেশ প্রদানের পর এখন বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তিনি আসলে থামবেন কোথায়?
মস্কো তার প্রতিবেশী দেশ জয় করার জন্য সম্ভাব্য সর্বাত্মক হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমা দেশগুলো সতর্ক করে দিয়ে আসছে। যদিও রাশিয়া শুরু থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে পুতিন যে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে ‘হামলার পরিকল্পনা নেই’ বিষয়টির সত্যতা মিলছে না।
বিজ্ঞাপন
সোমবার রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে পুতিন ইউক্রেন রাষ্ট্রের প্রকৃতি এবং এর নেতাদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন কখনোই রাষ্ট্র ছিল না। এর ফলে তিনি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ইউক্রেনকে পরাধীন করার লক্ষ্য নিয়ে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সম্ভাব্য তিন দৃশ্যপট
বিজ্ঞাপন
এক. বিদ্যমান ছিটমহলের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পর বিরতি
অনেক ভাষ্যকারের বিশ্বাস, বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিটমহলগুলোতে সৈন্য মোতায়েন রাশিয়ার ব্যাপক পরিসরে হামলা চালানোর প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। আবার অন্যান্যরা মনে করেন, ইউক্রেনের ওপর ভিন্ন উপায়ে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা অথবা একেবারে মাঠপর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় থেমে যাওয়ার প্রক্রিয়াও হতে পারে।
‘লিটল গ্রিন মেন: পুতিনস ওয়ারস সিনস ২০১৪’ বইয়ের লেখক টিম রিপলে বলেন, ‘সম্ভাব্য অভিযানের দৃশ্যপট তৈরির মাধ্যমে কঠিন সময় থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তবে তিনি কিছু করছেন। এ জন্য দেশের জনগণের কাছে বিজয় দাবি করতে পারবেন।
এখনই অন্যান্য অঞ্চল দখলে নেওয়ার চেষ্টার পরিবর্তে ইউক্রেনের ওপর ভিন্ন উপায়ে চাপ প্রয়োগের দিকে পুতিন মনোনিবেশ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন রিপলে।
তিনি বলেন, পরবর্তী সবচেয়ে সম্ভাব্য যে পদক্ষেপ পুতিনের পক্ষ থেকে আসতে পারে, সেটি হলো কৃষ্ণ সাগরে ইউক্রেনের বন্দরগুলোতে রাশিয়ার নৌ অবরোধ আরোপ। আর এর মাধ্যমে পুতিনের লক্ষ্য হবে ক্রমাগত সংকট বজায় রেখে ইউক্রেনীয়দের ভয় প্রদর্শন; যেখানে দেখানো হবে ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা ‘কাগুজে বাঘ’ ছাড়া কিছু নয়; যারা ন্যূনতম প্রকৃত সহায়তা করতে পারে না।
অবশ্য রাশিয়া ইতোমধ্যে বেশ কিছু বড় ধরনের লক্ষ্য অর্জন করেছে; যেমন— পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মিত্রদের প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে বাধ্য করেছে যে, তারা ইউক্রেনের সুরক্ষায় সৈন্য পাঠাবে না। এছাড়া প্রতিবেশী বেলারুশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি আদায় করেছে মস্কো।
রিপলে বলেন, ওই অঞ্চলের ভারসাম্য পরিবর্তনের জন্য বেলারুশ একটি বড় ‘গুটি’ ছিল... বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোকে ন্যাটো কীভাবে রক্ষা করবে; সেই ধারণায় রূপান্তর ঘটিয়েছে বেলারুশ।
দুই. পূর্ব ইউক্রেনে সংঘাত সীমিত রেখে বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল সম্প্রসারণের চেষ্টা
পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের দাবি করা দু’টি প্রদেশের অর্ধেকেরও কম নিয়ন্ত্রণ করে। ২০১৫ সাল থেকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের মাধ্যমে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ইউক্রেনের সৈন্যরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করা ছাড়াই রাশিয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল সম্প্রসারণের চেষ্টা করতে পারে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিটমহলের স্বীকৃতি ইউক্রেনের অন্যান্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতার দাবি মেনে নেওয়ার সমান কি না সে ব্যাপারে মস্কো গত ২৪ ঘণ্টায় মিশ্র সংকেত দিয়েছে।
এর একটি লক্ষ্য হতে পারে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের প্রধান বন্দর মারিউপোল। ২০১৪-১৫ সালে এই বন্দর ব্যবহার করে বিচ্ছিন্নতাবাদী হামলা ঠেকাতে সক্ষম হয়েছিল ইউক্রেন। এটি দখলে নিতে পারলে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত ক্রিমিয়া দ্বীপকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিটমহলগুলোর সাথে সরাসরি স্থলপথে সংযুক্ত এবং আজভ সাগরের উপকূলে মস্কোর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে।
কিন্তু পূর্ব ইউক্রেনের ক্রমবর্ধমান অঞ্চল নিয়ে যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিশ্বের কঠোর নিষেধাজ্ঞা আসবে এবং রাশিয়ার কৌশলগত অর্জন সীমিত হয়ে পড়বে। এর ফলে কিয়েভে পছন্দের সরকার ক্ষমতায় বসানোর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে মস্কো।
তিন. ব্যাপক-পরিসরের আক্রমণ
পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ— বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সতর্ক করে দিয়ে আসছে যে, পুরো ইউক্রেন দখল করার জন্য রাশিয়ার ব্যাপক পরিসরের হামলা চালানো অথবা কমপক্ষে কিয়েভের দিকে অগ্রসর হয়ে ক্ষমতাসীন সরকার উৎখাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
রিপলে বলেন, ‘দনেৎস্কের বাইরে মাত্র ছয়টি গ্রাম দখলে মোটেই কোনও পরিবর্তন আসবে না।’
অবশ্য কিছু ভাষ্যকার সোমবার রাতে ভ্লাদিমির পুতিনের টেলিভিশনে দেওয়া ‘বেপরোয়া’ ভাষণকে প্রমাণ হিসেবে দেখছেন যে, রাশিয়ার আধিপত্য স্বীকার করে এমন সরকার ইউক্রেনে না আসা পর্যন্ত তিনি সন্তুষ্ট হবেন না।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের সাংবাদিক এবং ‘দ্য লং হ্যাংওভার, পুতিনস নিউ রাশিয়া অ্যান্ড দ্য ঘোস্টস অব দ্য পোস্ট’র লেখক শন ওয়াকার লিখেছেন, ...সম্ভবত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং নিয়ন্ত্রিত ডি-ফ্যাক্টো অঞ্চলগুলোর আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে পুতিনের মাথায় আরও অনেক কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘পুতিনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, কিয়েভ যদি সহিংসতা বন্ধ না করে তাহলে আগামীতে রক্তপাতের দায়ভার তাদের বহন করতে হবে; যা চরম অশুভ। এটি অনেকটা যুদ্ধের ঘোষণার মতো শোনায়।’
সূত্র: রয়টার্স।
এসএস