উপরের বাম দিক থেকে: ইমরান খান, রূপালী চৌধুরী এবং লুমাত আহমেদ; নীচে বাম থেকে: ডঃ ওমর ইশরাক, আতা সাফদার এবং আবরার আনোয়ার

১৯৯৭ সালে এএনজেড গ্রিন্ডল্যস ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন মুহাম্মদ এ ( রুমি ) আলি। তখন থেকেই তিনি মনে মনে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নেতৃত্বে বাংলাদেশিদের খোঁজা শুরু করেন। কারণ তখনও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় পদগুলো বিদেশিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু এখন, পঞ্চাশের অধিক বাংলাদেশি বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

ব্যাংকিং, টেলিকম, ফার্মাসিটিক্যালস, টোব্যাকো, ফাস্ট মুভিং কনজু্মার গুডস এবং ক্লোথিংসহ একাধিক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশিরা। এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখ ইমরান খান, ড: ওমার ইসরাক, লুমাত আহমেদ, আবরার আনোয়ার, আতা সাফদার এবং এ রুমি আলি।

মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নেতৃত্বে বাংলাদেশিদের আনাগোনা গত এক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ বছর ড. ওমার ইন্টেল বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন। ইয়াসির আজমান গ্রামীণফোনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। নেপালের এনসেল এক্সিয়াটা লিমিটেডের বোর্ড মেম্বার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন মাহতাব উদ্দিন আহমেদ।

সিটিব্যাংক এনএ বাংলাদেশের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে সাড়ে নয় বছর ধরে কাজ করছেন মামুন রশিদ। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকেরই বলার মতো একটি গল্প আছে। এবং প্রত্যেকের গল্পই বেশ পরিচিত।’

তিনি আরও বলেন, সাধারণত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো অঞ্চলভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের প্রাধান্য দেয়। এতে স্থানীয় কার্যক্রম বিশেষ করে কোম্পানির লক্ষ্য উদ্দেশ্য, গ্লোবাল আউলুক, স্থানীয় সংস্কৃতি ও ক্রেতাদের চাহিদা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায়।
ফলে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো নিয়োগ দেওয়ার সময় যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মীদেরই নিয়োগ দিয়ে থাকে।

আগে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বিদেশিদের নিয়োগ দিতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তারা বাংলাদেশিদের শীর্ষস্থানীয় পদ অফার করছে বলে মন্তব্য করেন প্রাইজ ওয়াটার হাউজ কোপারসের ম্যানেজিং পার্টনার মামুন।

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশও শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে স্থানীয়দের সুযোগ দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন রুপালী চৌধুরী। তিনি এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে ২০০৮ সাল থেকে কর্মরত আছেন।

তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানির নেতৃত্বস্থানীয় পদে কয়েকজন স্থানীয় মেধাবী রয়েছেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে ১৯৯০ সালে প্লানিং ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন। এরপর বার্জার বাংলাদেশের মার্কেটিং, সেলস ও সাপ্লাই চেইন বিভাগে কাজ করেছেন।

এক্সপেডিটর বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, বেশিরভাগ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো স্থানীয়দের নিয়োগ দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের ইয়ং প্রফেশনালসরা বেশ যোগ্যতাসম্পন্ন। তাদের যেকোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজের সক্ষমতা রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. লতিফা জামাল বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। বিশেষ করে গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, ফেসবুক, উবার এমনকি লিংকডইনের মত টেক জায়েন্টে কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, আইটি খাতে বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ভালো ভালো জায়গায় কাজ করছে। এক সময় দেখা যেতো আইটি খাতের বড় বড় কোম্পানির বেশিরভাগ কর্মকর্তা ভারতীয়। সেখানে এখন বাংলাদেশের নাম যুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশি ছেলে মেয়েরা এসব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বস্থানীয় পদগুলো হোল্ড করছে।

এক নজরে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বাংলাদেশি নেতৃত্ব

মোহাম্মদ এ (রুমি) আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৭৫ সালে তিনি এএনজেড গ্রিনডলেজ ব্যাংকে (বাংলাদেশ) কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ব্যাংকটির বাংলাদেশ অপারেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। ২০০০ সালে ব্যাংকটি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড গ্রুপ কর্তৃক অধিগ্রহণের পর, তিনি ব্যাংক দুটির যৌথ কার্যক্রমেরও প্রথম সিইও নির্বাচিত হন।

২০০২ সালের নভেম্বরে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসাবে যোগ দেন। চার বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ব্র্যাক ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল বোর্ডের সদস্য হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে রুমি আলী এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের (বিয়াক)  সিইও হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।

আতা সাফদার রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশের ম্যানিজিং ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ পান ২০০২ সালে। বর্তমানে তিনি কোম্পানিটির সিংঙ্গাপুর শাখার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন।

গোলাম মহিউদ্দিন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন।

টেলকম কোম্পানি রবির ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন কামরান। এর আগে তিনি ইউনিলিভার বাংলাদেশকে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর আগে একই প্রতিষ্ঠানের নেপাল শাখার ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

শেহজাদ মুনিম বর্তমানে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছে। তিনি ২০১৩ সাল থেকে এ পদে নিযুক্ত আছেন।

সৈয়দ মুহাম্মদ কামাল বর্তমানে মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। এরআগে তিনি বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, ওয়েস্টান ইউনিয়ন ও এসএসএল ওয়ার্লেমে কর্মরত ছিলেন।

রবির সিইও হিসেবে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে যোগ দেন মাহতাব উদ্দিন। আবরার আনোওয়ার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, মালয়েশিয়া শাখার সিইও হিসেবে নিযুক্ত আছেন। এর আগে তিনি ব্যাংকটির বাংলাদেশ শাখার সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ইউনিলিভার বাংলাদেশ জাভেদ আখতারকে সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত করেছে। তার নিয়োগ কার্যকর হবে ১ জুলাই থেকে। জাভেদ ইউনিলিভারের দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি ভারতের দক্ষিণ এশিয়ার ডিজিটাল রূপান্তর ও প্রবৃদ্ধির সহসভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সেভেন রিং সিমেন্টের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন তাহমিনা আহমেদ। এর আগে, তিনি একই প্রতিষ্ঠানের  পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন।

মইন উদ্দিন মজুমদার ২০১৩ সাল থেকে সানোফি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৯৯৫ সালে এই সংস্থায় যোগদান করেছিলেন।

লুমাত আহমেদ এই বছর ফরাসি পোশাক ব্র্যান্ড ল্যাকোস্টে সর্সিং বিভাগের পরিচালক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এর আগে, তিনি দেশে বিদেশে বিভিন্ন পদে কয়েকটি পোশাক সোর্সি ব্র্যান্ডে কাজ করেছিলেন।

ইমরান খান ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আমেরিকান বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থা স্ন্যাপচ্যাট-এর প্রধান টেকনিক্যাল কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি  ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে লাইভস্ট্রিম শপিং অ্যাপ্লিকেশন ভারিশপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও হয়েছিলেন।

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী ড. ওমর ইশরাক ২০২০ সালের মে মাসে ইন্টেলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হন। তিনি সাত বছরের জন্য এই বোর্ডের দায়িত্ব পালন করবেন।

পোশাক খাতেও নেতৃত্বে বাংলাদেশিরা

জুলাই ২০১৯ সালে জিয়াউর রহমান এইচএন্ডএম বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ইথিওপিয়ার কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসাবে নিযুক্ত হন। এর আগে পোশাক শিল্পে তার ২০ বছরের অভিজ্ঞতা ছিল।

শোপনা ভৌমিক মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কান্ট্রি ম্যানেজার। এরআগে তিনি নেক্সট এবং ওয়ালমার্টের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের হয়ে কাজ করেছেন।

শফিউর রহমান জুলাই ২০১৩ সাল থেকে জি-স্টার র'র কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত আছেন। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে ইয়ংগন কর্পোরেশনের প্রোডাক্ট ডেভলপার হিসাবে তিনি তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন।

আরিফ রাজ্জাক কিবি ইন্টারন্যাশনাল সাপ্লাই সার্ভিসেস বাংলাদেশের আঞ্চলিক মার্চেন্ডাইজিং ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি সিয়ার্স হোল্ডিংস গ্লোবাল সোর্সিংয়ের কান্ট্রি ম্যানেজার এবং কেরফর গ্লোবাল সোর্সিং বাংলাদেশের সোর্সিং হাব ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে আরআর