ঘুরে ফিরে সেই পুরানো জায়গায় আমাদের ফিরে আসতেই হবে। এখনো অনেকেই বলেন, ব্যবসায়ের উপর কিছু নাই। যাই হোক, নিজে নিজে কিছু করলে হয়ত অন্যের কাছে ছোট হয়ে যেতে হয়, মূল্যায়ন পাওয়া যায় না কিংবা তথাকথিত সামাজিক স্ট্যাটাস পাওয়া যায় না। বর্তমান সময়ে এই ধরনের চিন্তা করার মানুষের সংখ্যা কম না। অনেকেই মনে করেন, এতদূর লেখাপড়া করে ব্যবসা করব? মানুষ কি মনে করবে এই চিন্তায় উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তাও করেন না। মনে রাখা দরকার, শুধুমাত্র সাহসী মানুষরাই উদ্যোক্তা হতে পারে। আর টেকসই উন্নয়নের জন্য উদ্যোক্তাদের বিকল্প নেই।

শেখ আকিজ উদ্দীন মাত্র ১৩ বছর বয়সেই ১৯৪২ সালে নিজ গ্রাম খুলনার ফুলতলার মধ্যডাঙ্গা ছেড়ে জীবিকার তাগিদে বেরিয়ে পড়েন। মাত্র ১৬ টাকা হাতে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসেন দুরন্ত এ কিশোর। কলকাতায় পাইকারি বাজার থেকে কমলা লেবু কিনে হাওড়া ব্রিজে ফেরি করা শুরু করেন। সেই থেকে শুরু। কিন্তু আমাদের দেশে বিএ, এমএ পাশ করে কেউ উদ্যোক্তা হওয়ার পথে যেতে চাইছে না। তবে হ্যাঁ, শুরুতেই যদি আকিজ কিংবা প্রাণ কোম্পানির মালিক বানিয়ে দেওয়া হয়, তবে সবাই সেটা করতে রাজি হয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখা উচিত, কেউ কিন্তু এক লাফ দিয়ে ২০০০ কোটি টাকার টার্নওভার করা কোম্পানির মালিক হন নি। আস্তে আস্তে করে সবাই সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। উদ্যোক্তাদের কিংবা ব্যবসা করার কয়েকটি ইতিবাচক দিক আমাদের জানা প্রয়োজন, যদিও বিষয়টি আমাদের সকলের জানা।

এক. আপনি স্বাধীনভাবে আপনার ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন। এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হবে না।

দুই. চাকরি করার ক্ষেত্রে আপনি যতই পরিশ্রম করুন কিংবা আপনার পরিশ্রমের ফলে প্রতিষ্ঠান যতই লাভবান হউক না কেন, আপনি নির্দিষ্ট অংকের বেতনের বাইরে কোন সুযোগ সুবিধা পাবেন না। অথচ উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যত লাভ হবে, সেই সুযোগ সুবিধা দিনশেষে উদ্যোক্তাদের পকেটেই চলে যাবে। এখানে সবসময় উদ্যোক্তাদের পরিশ্রম না করলেও চলে।

তিন. একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দাড় করাতে পারলে, সেটা শুধু উদ্যোক্তার নিজের জন্য নয়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও নিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থা করবে। আর ব্যবসা যতই পুরাতন হয় এবং উদ্যোক্তা হিসেবে সেটি বর্ধিত করার সুযোগ ততই বেড়ে যায়।

চার. সকল ধরনের চাকরি (খুব ছোট মানের) কিন্তু আপনাকে আর্থিক সচ্ছলতা দেবে না। কিন্তু একজন উদ্যোক্তা যদি নিজের বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে ব্যবসা চালাতে পারেন, তবে ব্যবসা তাকে আর্থিক সচ্ছলতা প্রদান করবে। যে কোন ভুলের কারণে, সকালে অফিসে গিয়ে জানা গেল চাকরি নেই, এমন ঘটনা উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ঘটার সুযোগ নেই।

পাঁচ. উদ্যোক্তারা নিজেদের বহুবিধ দক্ষতার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন। এখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পড়ে থাকা সুযোগ সুবিধার যেমন সর্বোচ্চ ব্যবহার যেমন সম্ভব, তেমনি কর্মসংস্থানেরও বিশাল সুযোগ সৃষ্টি সম্ভব। অফিসিয়াল বাধ্যবাধকতা উদ্যোক্তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলতে হয়না। বসদের নিকট জবাবদিহিতা থাকে না। কিন্তু সকাল বেলা অফিসে এসে চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার খবরও শুনতে হয়না। একথা সত্য, উদ্যোক্তাদের ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। লাভের পরিমাণ যেমন অপরিসীম, ঝুঁকির পরিমাণও তেমন বেশি থাকে। তবে হ্যাঁ, সঠিক সময়ে যারা কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তারা ব্যবসায়ে সাধারণত ক্ষতির সম্মুখীন হোন না।

সোশ্যাল মিডিয়ায় উদ্যোক্তা বিষয়ক একটা লেখা পড়লাম। সেটাই তুলে ধরছি। দিল্লিতে একজন সমুচা ওয়ালা ছিল এবং তার দোকানের সামনে একটি বড় কোম্পানির অফিস ছিল। একদিন এক ম্যানেজার দোকানে সমুচা খেতে গেল। ২ টা সমুচা নিয়ে সমুচা ওয়ালাকে প্রশ্ন করলো যে, তুমি খুব সুন্দর করে দোকানটা সাজিয়েছও, সিস্টেম গুলো ভালো, সুন্দর এডমিনিস্ট্রেশন, তাহলে তোমার এত সুন্দর প্লানিং নিয়ে আমার মত চাকরি করলে কি ভালো হতো না? সামুচাওয়ালা হাঁসি মাখা মুখে বলল, স্যার আমার কাজটা আপনার থেকে অনেক ভাল। আজ থেকে ১০ বছর আগে আমি সমুচা বিক্রি করতাম টুকরীতে। তখন আমার আয় ছিল প্রতি মাসে ১ হাজার এবং আপনার বেতন ছিল ১০ হাজার। আজ ১০ বছর পর আমার আয় ১ লক্ষ এবং কোন কোন মাসে ১ লক্ষের বেশি আর আপনার এখন বেতন ১ লক্ষ। তাহলে আপনার থেকে আমার কাজটা বেশি ভালো না? আমার পরে আমার এই ব্যবসা আমার ছেলে দেখবে। সে সাজানো একটা ব্যবসা পাবে কিন্তু আপনার ছেলে মেয়ে কি আপনার মত পজিশন পাবে? আমি শূন্য থেকে শুরু করেছি কিন্তু আমার ছেলে মেয়েরা শূন্য থেকে শুরু করবে না। চাকরিজীবীর সন্তানদের শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে। আপনি চাইলেও আপনার পজিশনে আপনার ছেলে মেয়েকে বসাতে পারবেন না। আপনি ১০ বছর আগে যে কষ্টটা করেছেন আপনার ছেলে মেয়েদের কেউ একই কষ্ট করতে হবে। আমার ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব আর আমি তাই আমি এই ব্যবসা করেছি যা আপনি পারেন নাই। লোকটা কথা গুলো শুনে ৫০ টাকা বিল পরিশোধ করে চলে গেল।

আমাদের দেশের এখনো অনেক ব্যবসায়ের চেয়ে চাকরি করাকে বেশি মানানসই মনে করে। এখান থেকে আমাদের সবাইকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। কভিডের এই সময়ে বেশ কিছু সংবাদ দেখলাম। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা শিক্ষার্থীরা গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ সার তৈরি করছে, বায়োফ্লিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করছে, ড্রাগন কিংবা বিদেশি খেজুর বাগান করছে। কেউ কেউ লাভবান হওয়া শুরু করছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এসব শিক্ষিত তরুণদের অনেকেই হয়ত চাকরির জন্য চেষ্টা করবে না। ব্যবসা করে যদি নিজে নিজেই স্বনির্ভর হওয়া যায় এবং সার্বিকভাবে টেকসই উন্নয়ন হয়, তবে অন্যের অধীনে থাকা কেন?

লেখকঃ অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক