শুচির স্ট্যানফোর্ডের গল্প
সানজিদা বেগ শুচি
সানজিদা বেগ শুচি। এস ও এস হারম্যান মেইনার কলেজ থেকে এসএসসি এবং হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসির পার্ট চুকিয়ে স্নাতক শেষ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। এখন ডক্টরেট করছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্য পথে হাঁটা শুচির গল্প তুলে ধরেছেন হাসান মেহেদী।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীদের স্নাতকের শেষ ক্লাস। শেষ ক্লাস সাধারণত বেশ আবেগের হয়ে থাকে। অনেককে শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে আসতেও দেখা যায়। তবে করোনাকালে ক্লাসগুলো অনলাইনে হওয়ায় এর কোনো উপায় না থাকলেও আবেগের কমতি ছিল না। অন্যান্য সবার চেয়ে শেষ ক্লাসটি অন্যরকম কাটলো ক্লাসের মেধা-তালিকায় প্রথমে থাকা সানজিদা বেগ শুচির। ক্লাস চলাকালীন একটি ইমেইলে উচ্ছ্বাস ফুটে উঠল শুচির মুখে। বুয়েটের মেধাতালিকায় আসার আনন্দের মতোই আরেকটি উপলক্ষের বার্তা যে তার ইমেইলে।
বিজ্ঞাপন
হ্যাঁ, প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যানফোর্ডে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছেন শুচি। এর চেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো জিআরই পরীক্ষা ছাড়াই ও গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগেই শুচি এই সুযোগ পেলেন।
শুচির কথায়- ‘আসলে জিআরই/জিম্যাট নিয়ে আমাদের বেশ ভুল ধারণা রয়েছে। আমরা সবাই মনে করি জিআরই ছাড়া অগ্রসর হওয়া যাবে না। এই ধারণা নিয়ে বসে থাকার কারণে অনেক সময় অনেক সুযোগ মিস করি আমরা। আমাকেও কয়েকজন বলেছিলেন জিআরই ছাড়া কিছুই সম্ভব না। তবে আগস্টের দিকে একদিন অনলাইনে ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমি দেখি, জিআরই ছাড়া কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), ক্যালিফোর্নিয়া টেক, স্ট্যানফোর্ডসহ বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করা যাচ্ছে। আমি এরপর আরেকটু খোঁজ নিয়ে কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি।’
বিজ্ঞাপন
‘আমার কাছে মনে হয়েছে- অনেক ভালো রেজাল্ট ও প্রোফাইল থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করি না। এজন্য আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছি।’
‘দেখা যায় সবাই বলে যে, আবেদনে প্রোফাইল ভালো না থাকলে ভালো স্কুলগুলোতে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার কাছে তা মনে হয়নি। আমার মনে হয় আবেদনের যোগ্যতা অর্জন করলে রেজাল্টের সাথে বাকি বিষয়গুলোও অনেকটাই গুরুত্ব বহন করে। এটা হতে পারে স্টেটমেন্ট অব পারপাস (এসওপি) ও অন্যান্য রচনা। এগুলার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষকরা সিদ্ধান্ত নেন।’
শুচি বলেন, ‘এবারও ব্যতিক্রম নয়, স্ট্যানফোর্ডসহ প্রথম সারির অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য জিআরই প্রয়োজন নেই। এর কারণ হিসেবে এমআইটির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, কিছু কিছু বিষয়ে পিএইচডিতে সাফল্যের সাথে জিআরইর সম্পর্ক নেই। এখানে আসলে তারা বৈষয়িক বিদ্যা এবং গবেষণা অভিজ্ঞতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।’
স্ট্যানফোর্ডে আবেদনে যা যা লেগেছে-
১. স্টেটমেন্ট অব পারপাস (এসওপি) : এসওপি-তে সাধারণত আগে কী করেছি তা কিছুটা তুলে ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি কী করতে পারব তা উল্লেখ করতে হয়। অথবা কোনো নির্দিষ্ট কোর্স আমার ঠিক কীভাবে কাজে লাগবে এবং এর থেকে পরবর্তীতে গবেষণায় কী ধরনের উপকারে আসবে তা তুলে ধরতে হয়। এসওপি যেকারও খুব মনোযোগ দিয়ে এবং সময় নিয়ে লেখা উচিত। আমার মনে হয় এসওপির ওপর অ্যাডমিশন অনেকাংশে নির্ভর করে।
২. রিসার্চ সামারি : বুয়েটে থাকাকালীন সময়ে আমি যা যা রিসার্চ করেছি তার সামারি উল্লেখ করতে হয়েছে।
৩. ডাইভারসিটি স্টেটমেন্ট : এটা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগে না। তবে আমাকে এটা দিতে হয়েছিল। আমি কেন অন্যদের থেকে আলাদা, আমি ওই কমিউনিটিতে কী বৈচিত্র্য নিয়ে যাব, কী ভ্যালু অ্যাড করব এসব বিষয় তুলে ধরতে হয়েছে। বাংলাদেশে প্রকৌশল উচ্চশিক্ষায় এবং চাকরিতে মেয়েরা কী ধরনের স্ট্রাগল করে তা আমি উল্লেখ করেছিলাম।
৪. সিভি : একটি ভালো গোছানো সিভি, যেখানে অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা থাকবে না।
৫. রেকমেন্ডেশন লেটার : তিন জন শিক্ষকের রেকমেন্ডেশন লেগেছিল। আমি আমার সুপারভাইজার ও অ্যাডভাইজরদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। এক্ষেত্রে আপনাকে যেসব শিক্ষক খুব ভালো চেনেন এবং যারা আপনার কাজগুলো সম্পর্কে ভালো জানেন তাদের রেকমেন্ডেশন নেবেন।
দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য আসলে কখন থেকে প্রস্তুতি শুরু করা উচিত?
শুচি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করার পরপরই এটা নিয়ে চিন্তা করে বাকি আনন্দগুলো নষ্ট করার কোনো মানে দেখি না আমি। এতে আবার নিজের রেজাল্টও খারাপ হয়ে যেতে পারে। অনেকেই রেজাল্ট খারাপ করেও দেশের বাইরে ভালো বৃত্তি পাচ্ছেন। কিন্তু তা কখনোই আদর্শ হিসেবে নেওয়া উচিত নয়। শেষ বর্ষের প্রথম থেকে সব কাজ আস্তেধীরে গুছিয়ে রাখা উচিত। তবে ভালো ফলাফল শুরু থেকেই ধরে রাখলে ভালো।
আমি যখন আবেদন করি তখন শেষবর্ষে পড়ছিলাম। তবে নতুন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরুর পূর্বেই আমি গ্রাজুয়েশন শেষ করব- এই শর্তে তারা আমাকে অ্যাডমিশন দেন। আমার মূলত ক্লাস শুরুর কথা ছিল ২০২১ এর সেপ্টেম্বরে। কিন্তু এর আগেই আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ায় তারা আমাকে সামারে আরেকটি ফেলোশিপ অফার করেছেন। এর কারণে জুন থেকে আমি শুরু করেছি। আমি এ বছরের জুনে ইউএসএ-তে এসে এখানে যোগ দিয়েছি। বর্তমানে জেনেটিক টার্গেটিংয়ের ওপর একটি কাজে রিসার্চ রোটেশন করছি। তিনটা ল্যাবে কাজ করার পর ল্যাব বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেবো।’
শুচি বলেন, ‘আমার ভায় ভালো যে, পরিবারের সাপোর্ট সবসময় পেয়েছি। আমার বাবা অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল হক বেগ নিজেও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। উনি সবসময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিতেন।’
তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় শুচি। বাবা অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল হক বেগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক। মা ইয়াসমিন আক্তার একজন গৃহিণী।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
‘আমার প্ল্যান আপাতত পিএইচডি শেষ করা। আমি এমন কিছু করতে চায় যাতে পৃথিবীর মানুষের কল্যাণ হয়। আমি ভালো কাজ করতে চাই, যেটা মানবকল্যাণে আসবে’- বলেন শুচি।
শেষ পরামর্শ
শুচির কথায়, ‘আমার সাজেশন একটাই। সাহস নিয়ে আবেদন করুন। বাংলাদেশের অনেকের ভালো প্রোফাইল থাকে, কিন্তু আবেদন করে না। আমি প্রথমেই বলব সবাই যাতে আবেদন করেন। চান্স পাওয়া না পাওয়া পরের বিষয়।
আর মেয়েদের জন্য স্পেশালি বলি, অনেক সময় ফ্যামিলি চায় না দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করে আসুক। এক্ষেত্রে ফ্যামিলিকে সুন্দর করে বোঝানো লাগবে। আমি অভিভাবকদের বলব- আপনারা সাপোর্ট দেন। ফ্যামিলি সাপোর্টিভ হলে অনেক সময় অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়।
আরেকটা বিষয় উল্লেখ্য, এবারও স্ট্যানফোর্ডসহ প্রথম সারির অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য জিআরই প্রয়োজন নেই। এর কারণ হিসেবে এমআইটির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, কিছু কিছু বিষয়ে পিএইচডিতে সাফল্যের সাথে জিআরইর সম্পর্ক নেই। এখানে আসলে তারা বৈষয়িক বিদ্যা এবং গবেষণা অভিজ্ঞতাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।’
এইচকে