শিবু দাশ সুমিত। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেটেছে তার শৈশব। প্রবল ইচ্ছা শক্তি, ধৈর্য আর অধ্যবসায় দিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন ৩৮তম বিসিএসে। পেয়েছেন অ্যাডমিন ক্যাডার। বর্তমানে কর্মরত আছেন নড়াইলের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) ও ট্রেজারি অফিসার হিসেবে। সম্প্রতি তিনি পড়াশোনা, সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন।

ঢাকা পোস্ট- আপনার ছেলেবেলার গল্প শুনতে চাই।

শিবু দাশ সুমিত- আমার ছেলেবেলা কেটেছে রাঙ্গামাটির একটি পাহাড়ি গ্রামে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ওই গ্রামেই ছিলাম। সেখানে রয়েছে আমার দুরন্ত শৈশব। সেসময় খুবই দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম। ছোট বড় সবাইকে অনেক জ্বালিয়েছি। আমার স্কুল পাহাড়ের উপরে থাকায় প্রতিদিন ছুটির পরে বন্ধুদের মধ্যে পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসার দৌড় প্রতিযোগিতা চলত। সেই স্মৃতি আজও মনে পড়ে। স্কুলের পাশেই ছিল আম গাছ। পড়ালেখার চেয়ে গাছের নিচে বসে থাকতে বেশি ভালো লাগতো আমার। 

ঢাকা পোস্ট- কত রকমের চাকরি আছে। বিসিএসকে কেন বেছে নিলেন?

শিবু দাশ সুমিত- জীবনের উদ্দেশ্য প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হয়। কখনো ভাবতাম ড্রাইভার হব। কখনোবা পাইলট আবার কখনো ফেরিওয়ালা। তবে পরিণত হলে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যও বদলাতে থাকে। আমার বেলায়ও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। স্কুলে পড়া অবস্থায় পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে প্রায়ই শিক্ষকরা বলতেন ম্যাজিস্ট্রেট স্যার আসবেন। দেখতে কেমন হবেন তিনি, কেন এতো সম্মান তার, কেনইবা এতো আলোচনা তাকে ঘিরে; এসব প্রশ্ন আমার মধ্যে উঁকি দিত। পঞ্চম শ্রেণিতে আমি বৃত্তি পরীক্ষায় দিলাম। সে পরীক্ষায় একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসলেন। পরীক্ষার হলে ঘুরে ঘুরে তিনি আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। একবার জিজ্ঞাসাও করলেন কেমন লিখছ, প্রশ্ন কেমন হয়েছে? সেই থেকে স্বপ্নের শুরু!

ঢাকা পোস্ট- কিভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ?

শিবু দাশ সুমিত- ৩৭তম বিসিএসে ভালো প্রস্তুতি না থাকায় আশানুরূপ ফল পাইনি। তবে ৩৮ বিসিএসে প্রস্তুতির শুরুতেই ‌‘জব সল্যুশন’র প্রিভিয়াস প্রশ্ন এনালাইসিস করেছিলাম। এরফলে কোন বিষয়গুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কোনটা বাদ দেওয়া প্রয়োজন, কোন বিষয়গুলো থেকে বার বার প্রশ্ন আসে এসব নিয়ে একটা ভালো ধারণা পেয়েছিলাম। যে বিষয়ে দুর্বলতা অনুভব করি, সেগুলো বেশি বেশি পড়েছি। মূল বইয়ের সঙ্গে সাপ্লিমেন্টারি বই সংগ্রহ করেছি। প্রথমদিকে সিলেবাস দেখে ভয় পেয়েছিলাম।

এছাড়াও মূল বই ছাড়াও সহায়ক বই, সংবাদপত্র-সাময়িকী নিয়মিত পড়েছি। বাংলা, ইংরেজি সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, মানচিত্র, ম্যাথ ও বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নোট করে রাখতাম এবং কিছুক্ষণ পর পর সেগুলো চোখ বোলাতাম। তবে ইংরেজি, বিজ্ঞান এবং ম্যাথে নিয়মিত সময় দিয়েছি।

ঢাকা পোস্ট- ৩৮তম বিসিএসে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিষয়টি জানার পর আপনার প্রতিক্রিয়া ছিল?

শিবু দাশ সুমিত- আমার কাছে মনে হয়েছে জীবনের সেরা অর্জনের মধ্যে এটি একটি। অনেক আবেগ, চাওয়া-পাওয়া আর উৎকণ্ঠার অবসান হয়েছিল সেই দিন। সময়টা ছিল সন্ধ্যার কাছাকাছি কোন এক মুহূর্ত। রেজাল্ট শিটে নিজের রোল খুঁজে পাওয়ার পর কিছু সময় স্থির হয়ে বারবার নিজের রোল ঠিক আছে কিনা তা দেখছিলাম। পরবর্তীতে ছোট ভাইকে বললাম ওয়েবসাইট থেকে রেজাল্ট শিটের পিডিএফ নামাতে। রোল খুঁজে পাবার পর সে বলল বিসিএস প্রশাসনে রোল আছে। সেই মুহূর্তটাকে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।সবকিছু মিলিয়ে সেদিনের সেই সন্ধ্যা ছিল এক প্রবল উচ্ছ্বাস আর আনন্দের।  

ঢাকা পোস্ট- বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিসিএস নিয়ে অন্যরকম উদ্দীপনা দেখা যায়। এমনকি কেউ কেউ বিসিএসকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনে করেন। এমনটা কি হওয়া উচিত?

শিবু দাশ সুমিত-  আমি মনে করি বিসিএস একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৪১ বিসিএস এ প্রায় চার লক্ষাধিকের বেশি শিক্ষার্থী আবেদন করেছে। কিন্তু পিএসসি মাত্র ২১ হাজারের একটু বেশি শিক্ষার্থীকে লিখিত পরীক্ষার জন্য বাছাই করেছে। শুধুমাত্র বিসিএস ওরিয়েন্টেড হওয়াতে আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার চিত্র হরহামেশাই বাড়ছে। এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। দিন শেষে বিসিএস প্রথম শ্রেণির একটি চাকরি মাত্র। জীবন সহজ, একে সহজ ভাবেই মেনে নিন। শুধু বিসিএসের চিন্তায় থেকে জীবনের অনেক সময় অযথাই হারিয়ে ফেলছি আমরা। বাড়ছে জীবনের সঙ্গে সময়ের দূরত্ব। তাই বিসিএস এর পাশাপাশি অন্য জবের চেষ্টা করাও উচিত।

ঢাকা পোস্ট - আপনার সফলতার পেছনে নিশ্চয় ব্যর্থতার গল্পও লুকিয়ে আছে। এমন কিছু ব্যর্থতার গল্প শুনতে চাই।

শিবু দাশ সুমিত- আপনি ব্যর্থ হতেই পারেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেউ কেউ ৬-৭ বার বিসিএস দিয়েও নিজেকে প্রমাণ করেছেন শুধুমাত্র সফল হয়ে। লেগে থাকার এই মানসিকতা নিয়েই তারা যদি সামনে এগিয়ে যেতে পারে তবে আপনি কেন নয়? এগিয়ে যেতে হলে আপনাকে ছাড় দিতে হবে, অনেক কিছু না দেখার এবং অনুভব না করার চেষ্টা করতে হবে। সবকিছু আঁকড়ে ধরতে গেলে বা বেশি গুরুত্ব দিলে এগিয়ে যেতে পারবেন না। আপনাকে প্রতিনিয়ত পরাজিত হতে হবে জীবনের বাঁকে বাঁকে। কিছু প্রশ্নের উত্তর কখনো মেলে না। চাইলেও নয়। দেয়ালের বিপরীত পাশে থেকে নেপথ্য অনুপ্রেরণাও একদিন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে যায়। জীবনের অনেক অসম্পূর্ণ গল্প থাকে, যার বাকিটা সময়ই চুকিয়ে দেয়। কত জীবন আছে দারুণ সম্ভাবনা থেকে ঝরে পড়ে নিভৃতেই, কিন্তু কি লাভ এসব জেনে, বিষাদ বাড়িয়ে!

ঢাকা পোস্ট- বিসিএস দিতে যারা আগ্রহী, তাদের জন্য কি পরামর্শ থাকবে?

শিবু দাশ সুমিত- নতুনদের জন্য বলতে চাই, কোন বিষয়টি রিডিং পড়ে মনে রাখবেন, কোন বিষয়টি নোট করবেন আর কোনটি বাদ দেবেন; সেটা নিজেকেই বের করতে হবে। নিয়মিত অনুশীলন সফলতার চাবিকাঠি। পড়ার মাঝে যেন গ্যাপ না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রস্তুতির এ সময়ে অনেক হতাশা কাজ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, আপনার জন্য যা মঙ্গল, সৃষ্টিকর্তা সেটাই আপনাকে দেবেন। কিন্তু প্রস্তুতিতে কোনো অবহেলা করা যাবে না। আপনার সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করে দৈনিক পরিকল্পনা করুন। প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করুন। পরিমিত চেষ্টা করুন আর ভরসা রাখুন আপনার প্রতিপালকের উপর। পাশাপাশি নিয়মিত পড়াশোনা, পরিবারকে সময় দেওয়া, তথ্য নির্ভর ইতিবাচক কাজে ফেসবুক ব্যবহার করা, নিয়মিত শরীর চর্চা এবং ধর্ম চর্চায় মন দিন। দিনশেষে শেষ হাসিটা আপনিই হাসবেন।

ঢাকা পোস্ট- ভাইভার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?

শিবু দাশ সুমিত- ভাইভা আসলে অনেকটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। ভাইভা বোর্ডের সদস্যদের মন মেজাজ সেদিন কেমন থাকে সেটাও একটা ফ্যাক্টর। পাশাপাশি ফেসবুকের বিসিএস রিলেটেড গ্রুপগুলোতে অনেক ইনফরমেশন পাওয়া যায়; যা বাজারের অনেক বইতেও পাওয়া মুশকিল। লাইক, কমেন্ট, চ্যাটিং না করে বিসিএস সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রুপ থেকে অনেক কিছুই জানতে পারবেন।

ঢাকা পোস্ট- পর্দার আড়ালে থেকে কেউ নিশ্চিই অনুপ্রেরণার জুগিয়েছে? কার কথা বেশি মনে পড়ে?

শিবু দাশ সুমিত- মা সবসময় সাহস যুগিয়েছেন। আমার প্রস্তুতির প্রতিটি মুহূর্তেই তিনি পাশে থেকেছেন। যুগিয়েছেন নিরন্তর সাহস-অনুপ্রেরণা। কোনো কিছুর পেছনে লেগে থাকার অদম্য ইচ্ছাটুকু তার কাছ থেকেই পাওয়া। সচরাচর দেখা যায় আপনি কোন কিছুর জন্য চেষ্টা করছেন, তখন আপনার পরিবারের চেয়ে অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের চিন্তা বেশি হয়। মূলত তাদের এই চিন্তাটা পজিটিভ অর্থে হয় না তেমন একটা। তখন ফ্যামিলি সাপোর্টটা অনেক জরুরি। সে সময়গুলোতে আমি যে সাপোর্ট পেয়েছি সেটা শুধুমাত্র মায়ের জন্য সম্ভব হয়েছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে তিনি শুধু আমাকে সমৃদ্ধই করে গেছেন।

ঢাকা পোস্ট- মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়েছিলেন?

শিবু দাশ সুমিত- কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে আমাদের নিয়োগ হয়। এই সময়টাতে সরাসরি জনগণের সান্নিধ্যে থেকে মাঠে কাজ করাটা বাস্তবিক অর্থেই বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। সরকার আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করতে গিয়ে মাঝেমাঝেই অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এছাড়া এ সময়ে জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিদিনই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, খোলাবাজারে ন্যায্য মূল্যে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি কার্যক্রম তদারকি, মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ আরো বিভিন্ন কাজ সরাসরি তদারক করতে হয়েছে। বলতে পারেন কাজের অনেক ভ্যারিয়েশন আছে। তাই চ্যালেঞ্জটাও আসলে বহুমুখী।

ঢাকা পোস্ট- আমাদের সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ।

শিবু দাশ সুমিত- আপনাদের জন্য অফুরান ভালোবাসা। ঢাকা পোস্টের জন্য নিরন্তর শুভকামনা।