সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের সম্পাদক পদের ফলকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে তুমুল হট্টগোল, হাতাহাতি ও সমিতির একটি কক্ষের কাঁচ ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। পাল্টাপাল্টি অবস্থান, মিছিল-স্লোগানে উত্তপ্ত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। 

পুলিশি প্রহরায় আইনজীবী সমিতির ভবনের কনফারেন্স কক্ষে সম্পাদক পদের ভোট পুনরায় গণণা করছে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের গঠিত নির্বাচনী সাব কমিটি। তবে এ নির্বাচনী সাব কমিটির সব কাজকে অবৈধ বলে দাবি করেছে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। তারা বলছেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত সাব কমিটিই ভোট পুনর্গণনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা ঢাকা পোস্টকে জানান, দুপুর সাড়ে ৩টায় আইনজীবী সমিতি ভবনের তিনতলায় সম্মেলন কক্ষের সামনে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে প্রথমে হাতাহাতি, পরে কিলঘুষির পর কক্ষের জানালার কাঁচ ভাঙচুর করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আওয়ামীপন্থী আইনজীবী নেতা অ্যাডভোকেট  মো. অজি উল্লাহর নেতৃত্বে একটি দল নির্বাচনের নতুন উপ-কমিটি দাবি করে ভোট পুনর্গণনা করে ফল ঘোষণা করতে সমিতির ওই সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করতে গেলে এ ঘটনার সূত্রপাত হয়। ওই কক্ষেই সমিতির নির্বাচনের ভোটের ব্যালটসহ অন্যান্য জিনিসপত্র রক্ষিত রয়েছে। সেখান থেকে অজি উল্লাহর নেতৃত্বে ভোট পুনর্গণনা করে সাত সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা নতুন উপ-কমিটির ফল ঘোষণার কথা মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান,  ভোট পুনর্গণনা করে ফল ঘোষণার জন্য ওই কক্ষে প্রবেশকে কেন্দ্র করে হাতাহাতি ও দুইপক্ষের আইনজীবীদের ধাক্কাধাক্কির মধ্যে কক্ষের তালা ভেঙে অজি উল্লাহর নেতৃত্বে একটি দল সেখানে প্রবেশ করে। এরপর কক্ষের বাইরে থেকে বিএনপিপন্থী আইনজীবী সদস্যরা কক্ষের কাঁচ ভাংচুর করেন।

এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি স্লোগানও দিতে দেখা যায়। দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। উভয়পক্ষের অনেকে আহত হয়েছেন। এ সময় কয়েকবার বাইরে থেকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা কক্ষের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর কয়েক দফা পাল্টাপাল্টি মিছিল-স্লোগানে উত্তপ্ত হয়ে উঠে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন। ফল গণনার স্থলে বিকেল পাঁচটার দিকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কনফারেন্স কক্ষে আওয়ামীপন্থী আইনজীবী নেতা মো. অজিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন সাব কমিটি সম্পাদক পদে ভোট পুনর্গণনা করছেন। কক্ষের সামনে আওয়ামীপন্থী আইনজীবী ও পাশে একদল পুলিশ অবস্থান করছে। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সমিতি ভবনের বিভিন্ন কক্ষে অবস্থান করেছেন। 

গত ১৫ ও ১৬ মার্চ সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামানের নেতৃত্বে সাত সদস্যের নির্বাচন উপ-কমিটি। এর একদিন পর ১৭ মার্চ ভোট গণনা করে রাতে ফল ঘোষণার সময় আওয়ামীপন্থী আইনজীবী প্যানেল পক্ষের সম্পাদক প্রার্থী ভোট পুণর্গণনার দাবি করে লিখিত আবেদন জানালে তখন ফল ঘোষণা আটকে যায়।

ওই রাতে ফল ঘোষণা না করে মশিউজ্জামান সমিতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।

দীর্ঘ এক মাস ১৩ দিন পর গতকাল মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্ট ল রিপোর্টার্স ফোরামে এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি অজি উল্লাহ দাবি করেন, গত ১২ এপ্রিল সমিতির কার্যকরী কমিটির মেয়াদের শেষ এক সভায় তাকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি নির্বাচন উপ কমিটি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমি নির্বাচন পরবর্তী অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য গত ১৬ এপ্রিল থেকে কার্যক্রম শুরু করেছি। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীকে (সম্পাদক) নোটিশ করি, বারের অফিসে নোটিশ করি। কক্ষের দাবি হস্তান্তরের জন্য এ ওয়াই মশিউজ্জামানকে ই-মেইলে পত্র প্রেরণ করি। তিনি চাবি হস্তান্তর করেননি, তারপর তার সাথে আদালতে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলি। 

বর্তমানে সমিতির কার্যক্রম ‘অচলাবস্থা’ বিরাজ করছে উল্লেখ করে অজি উল্লাহ বুধবার নির্বাচনের অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করবেন বলে ওই সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণাও দিয়েছিলেন।

এদিকে আইনজীবী সমিতির বর্তমান সম্পাদক ও বিএনপিপন্থী আইনজীবী প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, অজি উল্লাহ নির্বাচন পরিচালনায় উপ-কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে যে দাবি করছেন তা সঠিক নয়। যে সভায় অজি উল্লাহকে নির্বাচনের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বায়ক করা হয়েছে বলে তিনি যে দাবি করেছেন, ওই গত ১২ এপ্রিল সমিতির কোনো সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি বলে দাবি করেন কাজল।

রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন,  অজি উল্লাহ নেতৃত্বে তথাকথিত নতুন নির্বাচন সাব-কমিটি গঠন, ভোট কাউন্টিং বা নির্বাচনী ফলাফল বিষয়ে তাদের যে কোনো পদক্ষেপ অবৈধ। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সুমহান ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করার নির্লজ্জ অপচেষ্টা। এ ধরণের অবৈধ, নীতিহীন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য সবাই আহ্বান জানাচ্ছি। 

কী হয়েছিল ১৭ মার্চ রাতে

প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত ১০ জন আইনজীবী ঢাকা পোস্টকে জানান, ১৭ মার্চ দিবাগত রাত একটার দিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনের ভোট গণনা শেষ হয়। গণনা শেষে দেখা যায়, সভাপতিসহ ছয়টি পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাদা প্যানেল এবং সম্পাদকসহ আটটি পদে বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেল বিজয়ের পথে। 

সম্পাদক পদে নীল প্যানেলের ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আওয়ামী লীগের প্রার্থী থেকে অল্প ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। এ অবস্থায়  নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার প্রস্তুতি নিলে সম্পাদক পদে ভোট পুনরায় গণনার দাবি তোলেন আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা। তারা সম্পাদক পদে ভোট কারচুপি এবংবাতিল হওয়া ভোট কাজলের পক্ষে গণনা করার অভিযোগ আনেন।

নির্বাচন কমিশনের প্রধান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ. ওয়াই মশিউজ্জামান অভিযোগ নাকচ করে ফল ঘোষণা করতে অনড় থাকলে মিছিল, স্লোগান ও হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ব্যাপক হইচই শুরু করেন। 

এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সম্পাদক প্রার্থী আব্দুন নূর দুলাল লিখিতভাবে ভোট পুনরায় গণনার আবেদন করেন। আবেদন গ্রহণ না করলে নির্বাচন কমিশনের প্রধান এ ওয়াই মশিউজ্জামানের পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান দেন আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা।

উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে রাত সাড়ে তিনটার দিকে নির্বাচন পরিচালনায় গঠিত কমিটির প্রধান এ. ওয়াই মশিউজ্জামান সম্পাদক পদে ভোট পুনরায় গণনার আবেদন নেন এবং ভোটের ফলাফল ঘোষণা স্থগিত করেন। ওই সময় তিনি জানান, ১৮ মার্চ বিকেল তিনটায় দুই সম্পাদক প্রার্থীর উপস্থিতিতে ভোট পুনরায় গণনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

কিন্তু ১৮ মার্চ অ্যাডভোকেট এ. ওয়াই মশিউজ্জামান সুপ্রিম কোর্ট বারে আসেননি। এ কারণে ভোট পুনর্গণনার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

গত ১৫ ও ১৬ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই দিনব্যাপী নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পাঁচ হাজার ৯৮২ জন আইনজীবী ভোট দেন। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত প্রায় একটা পর্যন্ত চলে ভোট গণনা।

বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নির্বাচনি সাব কমিটির একাধিক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সভাপতিসহ ছয়টি পদে আওয়ামী লীগের সাদা প্যানেল ও সম্পাদকসহ আটটি পদে বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেলের প্রার্থীরা এগিয়ে আছেন। সভাপতি পদে সাদা প্যানেলের অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির ও সম্পাদক পদে নীল প্যানেলের ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এগিয়ে।

আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাদা প্যানেল থেকে এগিয়ে থাকা অন্য পাঁচজন হলেন, সহ-সভাপতি পদে মো. শহীদুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হোসেন, সদস্য পদে ফাতেমা বেগম, সাহাদত হোসাইন রাজিব ও সুব্রত কুমার কুন্ডু।

বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেল থেকে এগিয়ে থাকা অন্য সাতজন হলেন, সহ-সম্পাদক পদে মাহফুজ বিন ইউসুফ ও মাহবুবুর রহমান খান, ট্রেজারার মোহাম্মদ কামাল হোসেন, সদস্য ব্যারিস্টার মাহদীন চৌধুরী, গোলাম আক্তার জাকির, মো. মনজুরুল আলম সুজন ও কামরুল ইসলাম।

এমএইচডি/আরএইচ