ব্যারিস্টার সামিরা মাহমুদ

চট্টগ্রামের মেয়ে সামিরা মাহমুদ। রাজনৈতিক পরিবারে বড় হওয়া সামিরা ‘ও’ লেভেল- ‘এ’ লেভেল পাসের পর বাবার অনুপ্রেরণায় আইন বিষয়ে ভর্তি হন। চাচা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের পথ অনুসরণ করে ইংল্যান্ডের নর্দাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি অনার্স এবং লিংকন্স ইন থেকে বার এট ল’ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দেশে ফিরে প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের চেম্বারের জুনিয়র হিসেবে আইন পেশা শুরু করেন। এক বছর মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি বিকাশের সিনিয়র লিগ্যাল অফিসার ছিলেন।

২০১৪ সালে জজ কোর্টের ও ২০১৭ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এখন তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। সুনাম-ধন্য আইনি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান লিগ্যাল সার্কেলের জুনিয়র পার্টনার। পাশাপাশি গোল্ডেন হারভেস্ট অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানি ও স্বাধীন ফিনটিচ সলিউশন লিমিটেডের একজন ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর। আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যও তিনি। পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের আইনজীবী হিসেবে আইন-পেশায় অবদান রাখতে চান। নারী ও শিশুদের কল্যাণে কাজ করতে চান এই মেধাবী তরুণী। 

নতুন প্রজন্মের আইনজীবী ব্যারিস্টার সামিরা মাহমুদ তার এগিয়ে চলার গল্প বলেছেন ঢাকা পোস্টের কাছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম

পারিবারিক পরিচয় ও সোনালী দিনগুলো
আমি বড় হয়েছি চট্টগ্রামের খুব এডুকেটেড একটা ফ্যামিলিতে। ফ্যামিলির এতিহ্যের কারণেই সারাজীবন এডুকেশনের প্রতি আমাদের প্যাশন ছিল। আমার দাদার বাবা এবং আমার দাদীর বাবা দুজনই ল'ইয়ার ছিলেন। দাদীর বাবা ড. সানাউল্লাহ ১৯৩০ সালের দিকে বার এট ল’ করেছিলেন। তিনি সোয়াস ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন। নদী পথে তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন। আমার দাদার বাবা খান সাহেব আব্দুল হালিম, তিনিও একজন ল’ইয়ার ছিলেন। দাদা ৪২ বছরে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। কিন্তু ওই বয়সেও তিনি চট্টগ্রামে কটন মিল ও টেক্সটাইল মিলের পাইওনিয়র ছিলেন। তখনকার সময়ে উনি পাকিস্তান চেম্বার অব কর্মাসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমার দাদার তিন ছেলে এক মেয়ে। বাবা এবং দুই চাচা সবাই বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছেন।

ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জনের দিনে বাবা-মায়ের সঙ্গে লন্ডনে সামিরা মাহমুদ।

বড় চাচা সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বার এট ল’ ডিগ্রিধারী। ছোট চাচা একজন ডক্টর। বাবা মাহমুদ ইসা। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। মায়ের নাম নাহিদ মাহমুদ। তিনি সমাজ সেবামূলক কাজ করেন। নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করেন। আমরা তিন বোন। বড় বোনের নাম নাজিয়া করিম। দ্বিতীয় বোনের নাম কাশেফা মাহমুদ। আমি সবার ছোট। দুই বোনও দেশের বাইরে থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন। বড় বোন এখন আছেন জেনারেল ডায়নামিকসে। মেঝ বোন আমাদের কোম্পানি স্বাধীন প্রিন্টেক সলিউশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তিনি নিউইয়র্ক এবং বাংলাদেশে দুই দেশেই কাজ করেন। স্বাধীন প্রিন্টেক সলিউশনের আমি নিজেও পরিচালক।

ছোটবেলা-পড়ালেখা
চট্টগ্রামের জামালখান রোডে ছোটবেলা কেটেছে। স্কুলিং ছিল চট্টগ্রাম ইংলিশ মিডিয়াম গ্রামার স্কুল। তারপর ঢাকা চলে আসি। ঢাকায় প্রাইভেটে ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেল শেষ করি। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে খালেদ হামিদ চৌধুরী স্যারের লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্ট্যাডিজে (সাউথ) আইনে ভর্তি হই। সেখানে এক বছর পড়ালেখার পর ২০০৬ সালে লন্ডনে চলে যাই। নর্দাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৯ সালে এলএলবি অনার্স শেষ করি। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনের ওপর এলএলএম শেষ করি। ২০১১ সালে  ইংল্যান্ডের লিংকন্স ইন থেকে বার এট ল’ ডিগ্রি অর্জন করে দেশে চলে আসি।

কেন আইন পড়লেন?
আমাদের পরিবারের আমার দাদা বাবা খান সাহেব আব্দুল হালিম আইনজীবী ছিলেন। চাচা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আইনজীবী। ফ্যামিলি থেকে সব সময় অনুপ্রাণিত হয়েছি। ছোটবেলায় যখন দেখতাম বাবা-চাচারা পলিটিকস নিয়ে গল্প করছেন, শুনে ভালো লাগতো। মজা লাগতো। তখন থেকেই আমি ভাবতাম  আমিও সমাজের জন্য কিছু করব। এই ভাবনা থেকেই আইন পেশায়। বাবা আমাকে খুব অনুপ্রেরণা দিতেন ব্যারিস্টারি পড়ার। তিনি বিশ্বাস করতেন আমি আইন পেশায় ভালো করতে পারব। আমি এখনও জানি না এ পেশায় আমি কতটুকু সফল হতে পারব।  তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।  আইন পেশায়  আসার পর মনে হয় আমি পারব। এটাই আমার পেশা। আমাদের পরিবারে আগে দুই পুরুষ আইনজীবী ছিলেন। আমাদের পরিবারের থার্ড জেনারেশন আইনজীবী আমি।

ব্যারিস্টার মাহমুদের সঙ্গে কথা বলছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম।

বর্তমান কাজ ও  ব্যস্ততা
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে আইন পেশায় আছি। ২০১৭ সালের প্রথম থেকে আইনি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান লিগ্যাল সার্কেলের অ্যাসোসিয়েটস হিসেবে কাজ করছি। বর্তমানে লিগ্যাল সার্কেলের জুনিয়র  পার্টনার হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছি। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ইউনিভার্সিটি চিটাগাংয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিতে আছি। সম্প্রতি এখানে যোগদান করেছি। গোল্ডেন হারভেস্ট কোম্পানির স্বাধীন পরিচালক আমি। এই কোম্পানি কৃষি উপকরণ নিয়ে কাজ করে। দুটি প্রতিষ্ঠানের ডিসিশন মেকিংয়ে কাজ করে থাকি। তবে আমি মনে করি আমার লাইফের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট জার্নি হচ্ছে লিগ্যাল সার্কেল। এ চেম্বারের প্রত্যেকটা কলিগ আমরা একই ফ্যামিলির সদস্য হিসেবে মনে করি। আমাদের চেম্বারের সিনিয়র পার্টনার ব্যারিস্টার আনিতা গাজী রহমান, মহিবুল হাসান চৌধুরী, মাসুদ খান— ওনাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কলিগের মতো। আমরা সবাই সবাইকে হেল্প করি। সবাই সবাইকে ভালোর দিকে, ভালো ক্যারিয়ার গড়ার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আমাদের সিনিয়র ভেরি লিবারেল। নিজেদের সাইডে নিজেদের ক্লায়েন্ট বেইজড ক্রিয়েট করার সুযোগ আছে। এটা অ্যাবস্যুলেটলি ইনকারেজড। লিগ্যাল সার্কেলে পথচলাটা সত্যিই আমার জন্য গর্বের।

আইন পেশায় যাদের অনুসরণ করেন
আমার সিনিয়র ব্যারিস্টার আনিতা গাজী রহমান। তিনি আমার মেন্টর। তাকে সব সময় অনুসরণ করি। তার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শিখছি। এছাড়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেনের সাবমিশন আমার ভাল লাগে।

আইন পড়লে কি শুধু আইনজীবীই হতে হবে?
আমি এটা মনে করি না যে আইন পড়লে শুধু প্র্যাকটিসেই থাকতে হবে, আইনজীবী হতে হবে। আইন পড়ুয়াদের বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে।

আমার অনেক ফ্রেন্ড রয়েছেন যারা বিভিন্ন প্রফেশনে ভালো অবস্থানে আছেন। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, এমনকি বইয়ের প্রকাশকও আছেন। আমাদের দেশে ধারণা আইন পড়লে শুধু কোর্টে গিয়ে ওকালতি করতে হবে। এটা রং কনসেপ্ট। এই ধারণাটা ভাঙতে হবে। বতর্মানে  আইন পড়ুয়াদের  কমার্শিয়াল, করপোরেট প্র্যাকটিস, ইন হাউজ কাজ করার প্রচুর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

আইন শিক্ষার্থীদের জন্য যা বলতে চান
আমি মনে করি আইন পেশায় সফল হওয়ার জন্য প্যাশন,  ধৈর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে মনে হয় এখনকার জেনারেশনের যারা আছেন তাদের খুব সহজে মন ভেঙে যায়। বা খুব সহজে প্যাশন হারিয়ে ফেলে। সেটা করা যাবে না। যারা আইন পেশায় ভালো করতে চায় তাদের ধৈর্য রাখতে হবে এবং শেখার আগ্রহ নিয়ে কাজ করে যেতে হবে। এই প্রফেশনে এত বিস্তৃত নলেজ রাখতে হয় যে ছোটদের থেকে শিখলেও আমি ছোট হয়ে যাব না। অনেক পড়াশুনা করতে হবে। ছোট বড় সবার কাছ থেকে নলেজ গ্যাদার করতে হবে। সারাক্ষণ শিক্ষার মধ্যে থাকতে হবে। জানার আগ্রহটা থাকতে হবে। প্রথম পরামর্শটা হচ্ছে নলেজ গ্যাদার করতে হবে। ধৈর্য নিয়ে আইন পেশায় লেগে থাকতে হবে।

নারীদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা
নারীরা অনেক শক্তিশালী। আমাদের অনেক রকম গুণ রয়েছে। প্রত্যেকটা আইডেন্টেটি ও প্রত্যেকটা গুণকে কাজে লাগাতে হবে। মা হিসেবে, বোন হিসেবে, ওয়ার্কিং পার্সন হিসেবে আমাদের যে পরিচয় রয়েছে এগুলো ইউনিক আইডেন্টিটি। এগুলোকে আরও অ্যাডভানস করা এবং সোসাইটিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যেন লাইফের যেকোন সিচুয়েশনে নিজেকে তৈরি করতে পারি। মনোবল ও শক্তি  অর্জন করে এগিয়ে যেতে হবে।

স্বপ্ন-ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
প্রথমত  আইন পেশায় আমি অনেক দূর আগাতে চাই। ভবিষ্যতে  নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। সমাজে যে নারী ডমেসটিকস ভায়োলেন্সের শিকার হয়, নির্যাতনের শিকার হয় আমি তাদের কল্যাণে কাজ করব। এসব নারীদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করব। আমি মনে করি ব্যক্তিগতভাবে মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া, অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারা খুবই প্রয়োজন। দারিদ্র্যতার কারণেই মেয়েরা ডমেসটিকস ভায়োলেন্স, বাল্য বিবাহের শিকার হয়। অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারলে নারীরা নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে পারে। সমাজে নিজেদের পরিচয়ে চলতে পারবে। ভবিষ্যতে অসহায়-নির্যাতিত নারীদের অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করার উদ্যোগ নেওয়ার প্রত্যাশা রাখি।

এমএইচডি/এসএম