চুমকি কারনের নিজস্ব কোনো আয়-উপার্জন না থাকা সত্ত্বেও প্রদীপ কুমার দাশের অবৈধ উপার্জনকে বৈধ করার কৌশল হিসেবে তাকে মৎস্য ব্যবসায়ী ও কমিশন ব্যবসায়ী দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের দুইজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত এমন কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন মামলায় দুদকের আইনজীবী চট্টগ্রাম আদালতের পিপি মাহমুদুল হক।  

তিনি বলেন, আদালত রায়ে বলেছেন, প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে রোজগার করা অবৈধ উপার্জন হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে আসামি চুমকি কারনের নামে জমি, ফ্লাট, বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি গড়েছেন।

আদালত রায়ে বলেছেন, দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে আসামিরা ২০ ভরি সোনার তথ্য গোপনসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদের মূল্যকে অপরাধ গোপনের উদ্দেশ্যে কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।

আরও পড়ুন>> দুর্নীতির মামলায় প্রদীপের ২০ ও স্ত্রীর ২১ বছরের কারাদণ্ড

তিনি বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অপরাধ করেছেন। যা আমরা মৌখিক, দালিলিক ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যর মাধ্যমে প্রমাণে সক্ষম হয়েছি। 

এদিকে আদালত ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটার ‘লক্ষিকুঞ্জ’ ভবনের ৬ষ্ঠ তলার উপরের ২টি কক্ষ, চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার পশ্চিম ষোল শহর মৌজায় অবস্থিত ১ কোটি ৩৯ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকার জমি ও সেমিপাকা ঘর, কক্সবাজারের ঝিলংজা ভবনের ১১ তলায় অবস্থিত একটি ফ্ল্যাট, ২২ লাখ ৮২ হাজার টাকা মূল্যমানের দুটি মাইক্রোবাস রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। 

আরও পড়ুন>> দুর্নীতি করিনি, ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছি : প্রদীপ

সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার স্ত্রী চুমকি কারনের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতি মামলার রায়ে আদালত প্রদীপ কুমারকে ২০ বছর ও তার স্ত্রীকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এছাড়া তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কথা বলা হয়েছে। 

বুধবার (২৭ জুলাই) চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ মুন্সী আব্দুল মজিদের আদালতে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

দুদকের মামলার আইনজীবী চট্টগ্রাম আদালতের পিপি মাহমুদুল হক ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ২৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষে আদালত এই রায় দিয়েছেন। 

পিপি মাহমুদুল হক বলেন, দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ধারায় চুমকি কারনকে একবছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া  ১ লাখ টাকা জরিমানা ও একমাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আর ২৭(১) ধারায় প্রদীপ ও চুমকীকে ৮ বছর করে কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন আদালত। এছাড়া মানি লন্ডারিং আইনের ৪(২), (৩) ধারায় প্রদীপ ও চুমকী প্রত্যেককে ১০ বছর করে কারাদণ্ড ও ৪ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় চুমকি ও প্রদীপকে ২ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া এই ধারায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সব সাজা একসঙ্গে চলবে। এছাড়া একইসঙ্গে প্রদীপ ও চুমকীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কথা বলেছেন আদালত। 

এর আগে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে প্রদীপ ও চুমকিকে আদালতে আনা হয়। রায় ঘোষণার পর তাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। 

প্রদীপের আইনজীবী সমীর দাশ গুপ্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, রায়ে আমরা সম্পূর্ণভাবে অসন্তুষ্ট। আমরা উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।

রায়ের পর পিপি মাহমুদুল হক বলেন, আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। তাই আদালত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি দিয়েছেন। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ বাদী হয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দীন। 

দুদক আইন ২০০৪-এর ২৬ (২) ও ২৭ (১), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪ (২) ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল।

এরপর গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক মুন্সী আব্দুল মজিদ দুর্নীতি মামলার চার্জ গঠনের মাধ্যমে প্রদীপ এবং তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন।

এর আগে গত বছরের ২৬ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন। প্রদীপ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকলেও চলতি বছরের ২৩ মে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন প্রদীপের স্ত্রী চুমকি। পরে আদালত শুনানি শেষে তাকে কারাগারে পাঠান। 

জানা গেছে, চুমকির ৪ কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫১ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিপরীতে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৪ টাকা। বাকি সম্পদ অর্থাৎ ২ কোটি ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৭ টাকার সম্পদ অবৈধভাবে অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় ছয়তলা বাড়ি, ষোলশহরে একটি বাড়ি, ৪৫ ভরি স্বর্ণ, একটি কার ও মাইক্রোবাস, কক্সবাজারের একটি ফ্ল্যাটের মালিক প্রদীপের স্ত্রী চুমকি। প্রদীপের ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে স্ত্রী চুমকি এসব সম্পদ অর্জন করেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে। এছাড়া চুমকি নিজেকে মাছ ব্যবসায়ী দাবি করলেও তার কোনো প্রমাণ পায়নি দুদক।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর মেরিনড্রাইভ চেক পোস্টে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় একই বছরের ৬ আগস্ট থেকে কারাগারে রয়েছেন ওসি প্রদীপ। সিনহা হত্যা মামলায় প্রদীপকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

কেএম/জেডএস