৩৫ বছর আগে গাজীপুরে তুচ্ছ ঘটনার জেরে দুই প্রতিবেশীর মামলাকে কেন্দ্র করে একজনের এক বছরের সাজার রায় বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টেও বহাল থাকায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে তুচ্ছ ঘটনার মামলার ক্ষেত্রে সাজা না দিয়ে বিচারকদের আপস-মীমাংসার ওপর জোর দিতে বলেছেন আপিল বিভাগ।

মামলার নিষ্পত্তি করে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুচ্ছ কারণে এই ঘটনা ঘটেছিল। এসব ক্ষেত্রে আসামিকে এক বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচীন ছিল।

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ রায় দেন। রায়ের অনুলিপি মঙ্গলবার (২ মার্চ) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

রায়ে আপিল বিভাগ আরও বলেন, যেহেতু দণ্ডবিধির ৩২৩ ও ৩২৫ ধারা আপসযোগ্য অপরাধ এবং যেহেতু দুই পক্ষ পরস্পর আত্মীয়/প্রতিবেশী কাজেই মামলাটি আপস-মীমাংসা করা যুক্তিযুক্ত ছিল।

সর্বোচ্চ আদালত রায়ে বলেন, ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’-এর বিধানা বিচারিক আদালত, আপিল আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রয়োগযোগ্য। অথচ আগের আদালতগুলোর তিনটি রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে, বিচারকরা এই আইনের বিষয়ে আদৌ অবগত আছেন কি না। যদি এই আইন প্রয়োগের বিষয়ে ধারণা থাকতো তাহলে রায়ে বলা থাকতো কেন এই আইন প্রয়োগ সমীচীন নয়। যদি এই আইন সঠিকভাবে বিচারিক আদালতে প্রয়োগ করা হতো তাহলে এ ধরনের মামলা আপিল বিভাগ পর্যন্ত আসত না।

রায়ে আদালত বলেন, দেশের শতকরা ৬২ ভাগের অধিক লোক গ্রামে বাস করে। যেখানে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শহরের তুলনায় বেশি। তাদের মধ্যে ছোট-খাটো ঝগড়া-বিবাদও বেশি হয়। এই মামলার ঘটনা শুরু হয়েছিল খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। ১৯৮৬ সালের ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় আসামি আব্দুল মতিনের সাথে বাদী আহমদ আলীর ১০/১২ বছরের নাতি আব্দুল বাকির কথা কাটাকাটি হয়। ওইদিনই সন্ধ্যায় এই ব্যাপারে সালিশ হয় ও মতিনকে সালিশে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ফলে আসামিপক্ষ প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেয়। পরের দিন সকাল ৬টায় আসামি মতিনের ভাই আসামি নুর মোহাম্মদ বাদীর ছেলে আব্দুল জব্বারকে আক্রমণ করে। একটি ফলার চ্যাপ্টা অংশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে রক্তাক্ত জখম করে ও তার বাম হাতের কব্জি ভেঙ্গে দেয়। মোট ছয় জন আসামি বাদী পক্ষের চার জনের শরীরে বিভিন্ন আকারের জখম করে। এর মধ্যে আব্দুল জব্বার সবচেয়ে গুরুতর আহত হয়।

বিচার শেষে ১৯৯৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বিচারক বর্তমান আবেদনকারী নুর মোহাম্মদকে দণ্ডবিধির ৩২৫ ধারার অপরাধের জন্য এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য দুই হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। অন্যান্য আসামীদেরকে দণ্ডবিধির ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য যথাক্রমে দুই হাজার টাকা ও পাঁচশত টাকা জরিমানা করেন।

এর বিরুদ্ধে আসামিরা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন। যা ২০০৫ সালের ৭ জুলাই খারিজ হয়ে যায়। পরে আসামিরা হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২ মার্চ আবেদনটি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। ওই খারিজের আদেশের বিরুদ্ধে আসামি নুর মোহাম্মদ আপিল বিভাগে আবেদন করেন।

রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, বিচারিক আদালতের বিচারক ও আপিল আদালতের বিচারক সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন যে, আমাদের দেশে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ নামে একটি আইন আছে ও বর্তমান মামলার প্রেক্ষাপটে সেই আইনের ৫ ধারা প্রয়োগযোগ্য। যখনই বিচারক ৩২৫ ধারার অপরাধে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করলেন, তখনই উনার উচিত ছিল ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’-এর ৫ ধারা বিবেচনা করা। মামলার বিষয়বস্তু থেকে বুঝা যায় যে, এই ঘটনা দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুচ্ছ কারণে ঘটেছিল। এসব ক্ষেত্রে আসামিকে এক বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচীন ছিল। এমনকি, যেহেতু দণ্ডবিধির ৩২৩ ও ৩২৫ ধারা আপসযোগ্য আপরাধ ও যেহেতু দুই পক্ষ হচ্ছে পরস্পর আত্মীয়/প্রতিবেশী কাজেই মামলাটি আপস মীমাংসা করা যুক্তিযুক্ত ছিল। আমরা আরো দুঃখের সাথে বলতে চাচ্ছি যে, এ ধরনের মামলার ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ প্রয়োগ না করা শুধু দুঃখজনকই নয় প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।

নিম্ন আদালতের দুই জন বিচারক ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক কেউই ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ অথবা আপস মীমাংসার ব্যাপারে চিন্তা করেননি এবং দণ্ড ও সাজা বহাল রাখেন। ইতিমধ্যে আবেদনকারী নুর মোহাম্মদ ৩১ দিন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। আবেদনকারী নুর মোহাম্মদের দোষী সাব্যস্তের আদেশ ও জরিমানা বহাল থাকবে। তবে তিনি যতদিন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন ততদিনই তার দণ্ড হিসেবে গণ্য হবে উল্লেখ করে নুর মোহাম্মদের আবেদন নিষ্পত্তি করে দেন আপিল বিভাগ।  

এমএইচডি/ওএফ