একসময় রান্নাবান্না আর পরিবার সামলানোই প্রধান দায়িত্ব ছিল নারীদের। তবে সময়ের পরিক্রমায় এখন দেশের প্রতিটি খাতেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন তারা। রেখে চলছেন যোগ্যতার স্বাক্ষর। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টেও দৃপ্ত পদচারণায় এগিয়ে চলছেন নারীরা। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ১০ হাজার ৩৬৩ সদস্যের মধ্যে ১ হাজার ৭৩৭ জনই নারী। 

রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন অনেকে। স্বাধীনতার ২৮ বছর পর ২০০০ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে  প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান নাজমুন আরা সুলতানা। এরই মধ্যে তিনি অবসরেও চলে গেছেন। তার প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও বিচারিক ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ এ পদে নারীদের অংশগ্রহণের পথ আরও সুগম করে। বর্তমানে উচ্চ আদালতে সাতজন নারী বিচারপতি রয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। বিচারাঙ্গনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নির্ভীক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে  তারা প্রতিষ্ঠা করছেন ন্যায়বিচার। নারী বিচারপতিরা হলেন, বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী,  ফারাহ মাহবুব, নাইমা হায়দার, কৃষ্ণা দেবনাথ, কাশেফা হোসেন, ফাতেমা নজীব ও কাজী জিনাত হক। 

উচ্চ আদালতের প্রথম নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, উচ্চ  আদালতে নারী বিচারপতির সংখ্যা আনুপাতিক হারে কম। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আরো নারী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, সারাদেশের নিম্ন আদালতগুলোয় সাড়ে পাঁচশর মতো নারী বিচারক দায়িত্ব পালন করছেন। এটা অনেক বড় অগ্রগতি। উচ্চ আদালতে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আরো  নারী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে, নারী দিবসে এটাই আমার প্রত্যাশা।

বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যারিস্টার রাবেয়া ভুঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে নারীরা মোটামুটি ভালোভাবে এগিয়ে চলছে। যদিও আইন পেশায় নারীদের কিছুটা প্রতিবন্ধকতা আছে। নারী আইনজীবীরা ক্লায়েন্টদের কাছে ততটা গ্রহণযোগ্যতা এখনও অর্জন করতে পারেননি। আশা করি, এ সমস্যা অচিরেই দূর হয়ে যাবে। এখন তো অনেক নারী বিচারপতি হয়েছেন। নিম্ন আদালতেও অনেক নারী বিচারপতি দায়িত্ব পালন করছেন। তারা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আমি মনে করি, উচ্চ আদালতে আরো নারী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া উচিত। কারণ, নারী আইনজীবীদের মধ্যে জাস্টিস হওয়ার মতো অনেকেই আছেন। একনজরে উচ্চ আদালতের ৭ বিচারপতি-

বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী
বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর বাবা সাবেক বিচারপতি এ টি এম মাসুদ। ১৯৮১ সালের ২২ আগস্ট তিনি ঢাকা জেলা জজ আদালতে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৮৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৯৬ সালের ১৪ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই বছর পর ২০০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

বিচারপতি ফারাহ মাহবুব
বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের বাবা সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম পাসের পর ১৯৯২ সালে জেলা আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৯৪ সালের ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টে এবং ২০০২ সালের ১৫ মে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। ২০০৬ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে পূর্ণাঙ্গ বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

বিচারপতি নাইমা হায়দার
বিচারপতি নাইমা হায়দার সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর মেয়ে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এছাড়া কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কেল বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৯ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন। ১৯৯৩ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী এবং ২০০৪ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি ২০০৯ সালের ৬ জুন হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১১ সালের ৬ জুন হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ
বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে লেখাপড়া সম্পন্ন করার পর মুনসেফ হিসেবে ১৯৮১ সালের ৮ ডিসেম্বর বিচার বিভাগে যোগদান করেন। এরপর ১৯৯৮ সালে তিনি জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এর দুই বছর পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

বিচারপতি কাশেফা হোসেন
বিচারপতি কাশেফা হোসেনের বাবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ হোসেন। তিনি ইংরেজি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া লন্ডনেও একই বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন। পরে ২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কাশেফা হোসেন।

বিচারপতি ফাতেমা নজীব
নরসিংদীর জেলা ও দায়রা জজ বেগম ফাতেমা নজীব ২০১৮ সালের ৩০ মে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।  ২০২০ সালের ৮ জুন তাকে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিচারপতি কাজী জিনাত হক
কাজী জিনাত হক একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শরীফা খাতুনের কনিষ্ঠ কন্যা। এর আগে তিনি দুই মেয়াদে  ডেপুটি  অ্যাটর্নি  জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি  জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর কাজী জিনাত হক হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

এমএইচডি/এসকেডি/এমএমজে