তাজরিয়ান মোস্তফা মৌমিতা

আমি আমার দুই মেয়েকে নিয়ে মালয়েশিয়ায় থাকতাম। তারা সেখানে পড়ালেখা করত। লকডাউনের কারণে আমি মেয়েদের নিয়ে বাংলাদেশে আসি। আগামী মাসে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কীভাবে যে একটি ঝড় এসে আমার পুরো পরিবারকে তছনছ করে দিল। আমাদের ও তার ইচ্ছে ছিল সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু সে তো আর ইঞ্জিনিয়ার হতে পারল না। আমাদের সব স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল। 

রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় বাসার ছাদ থেকে পড়ে নিহত তাজরিয়ান মোস্তফা মৌমিতার (২০) মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঢাকা পোস্টকে এসব কথা বলছিলেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারির (শুক্রবার) ওই ঘটনায় মৌমিতার বাবা কলাবাগান থানায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মৌমিতার মা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে ডাক্তারি পড়াশোনা করে। মেজো মেয়ে মৌমিতা মালয়েশিয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিল। আর ছোট মেয়ে ও-লেভেলে পড়ালেখা করে। মেজো ও ছোট মেয়েকে নিয়ে আমি মালয়েশিয়ায় থাকতাম।

মৌমিতার মা আরও বলেন, ‘আমার মেয়ের তো কারোর সঙ্গেই শত্রুতা ছিল না। কিন্তু কেন এমন হলো? কেন আমার মেয়েকে হত্যা করা হলো? কী করছিল আমার মেয়ে? শুধু এতটুকু জানি আমার মেয়েরা বাসার ছাদে গেলে বাড়ির মালিকের ছেলে ফাইজার ও তার বন্ধুরা মিলে বাসার ছাদে আড্ডা দিত। তারা আমার মেয়েকে বিরক্ত করত। প্রতিবাদ করলে ফাইজার ও তার পরিবার আমাকে ও আমার মেয়েকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ব্ল্যাকমেল করেছিল। আমি বুঝি না আমার মেয়ের কী হয়ে গেল।

তিনি আরও বলেন, ‌‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটাই অনুরোধ, যারা আমার বুক খালি করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়।’

মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে
মৌমিতার বাবা মামলার এজাহারে বলেন, তার মেয়ে এশিয়ান প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির (এপিইউ) কুয়ালালামপুর শাখায় বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (আইটি) দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করত। করােনার কারণে গত বছরের ১৮ জুলাই দেশে ফিরে আসে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মৌমিতা একা বাসার ছাদে ঘুরতে যান। মৌমিতাকে বাসায় দেখতে না পেয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সে ছাদে আছে।

মৌমিতাকে দ্রুত ছাদ থেকে বাসায় ফিরে আসতে মেসেজ দেন। সে মেসেজ পেয়ে উত্তরে আসছি বলে তার বাবাকে মেসেজ পাঠায়। এরপরও মৌমিতা ছাদ থেকে ফিরে না আসায় বিকেল আনুমানিক ৪টা ৪৫ মিনিটে তার বাবা বাসার কাজের ছেলে মুজাহিদকে ছাদে পাঠায়। একটু পরে সে ফিরে এসে জানায়, ছাদে যাওয়ার দরজা ভেতরের থেকে আটকানাে। তাই সে ছাদে যেতে পারেনি। তবে দরজার ভেতরে অর্থাৎ ছাদে অনেকের হইচই ও খেলাধুলা করার শব্দ শুনতে পেয়েছে। 

মৌমিতার বাবা পূর্বনির্ধারিত অফিসিয়াল কাজে বাসা থেকে বের হয়ে যান। কাজ শেষে ৬টা ১৭ মিনিটে মৌমিতার খোঁজ নেওয়ার জন্য মেসেঞ্জারে কল দিলেও মৌমিতা রিসিভ করেনি। এর কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা ৬টা ২২ মিনিটে স্ত্রীর মেসেঞ্জার থেকে ছােট মেয়ে তাকে কল করে চিৎকার ও কান্নাকাটি করেন। দ্রুত গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে বলেন। সেখানে এসে মৌমিতাকে অচেতন অবস্থায় স্ট্রেচারের ওপরে দেখেন। কিছুক্ষণ পর ৬টা ৩২ মিনিটে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘােষণা করেন। 

তখন মৌমিতার মা ও অপর দুই বোন তার বাবাকে জানান, লােকজনের থেকে জানতে পারেন সন্ধ্যা ৬টার দিকে তাদের বাসার ছাদের পেছনে গ্রিনরােড স্টাফ কোয়ার্টারের ভেতরের দিকে কাউকে পড়তে দেখে স্থানীয় লােকজন চিৎকার চেঁচামেচি করছে। তখন বড় মেয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে মৌমিতার পরিহিত কাপড়। ছােট মেয়ে ও স্ত্রী দৌড়ে গিয়ে স্থানীয় লােকজনের সহযােগিতায় মৌমিতাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।

মৌমিতার বাবা এজাহারে আরও উল্লেখ করেন, ফাইজার ও তার বন্ধু আদনান, তানভীর, ত্রিনয়, ফাইজারের বান্ধবী অপরাজিতাসহ আরও কয়েকজন বন্ধু ফাইজারের নেতৃত্বে নিয়মিত ছাদে এসে আড্ডা দিত, ক্রিকেট খেলত ও উচ্ছৃঙ্খল সময় কাটাত। করােনার কারণে একটানা বাসায় থাকায় একঘেয়েমি দূর করতে মাঝে মধ্যে মৌমিতা ছাদে যেত। সেই সুযােগে ফাইজার ও তার বন্ধু আদনানের সঙ্গে মৌমিতার পরিচয় হয়। পরে তারা মৌমিতাকে ছাদে গেলেই বিরক্ত করত। গত সপ্তাহে মৌমিতার মা তার বাবাকে এসব জানান। এরপর মৌমিতার মা ফাইজারের মাকে জানালে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে মৌমিতার মাকে বিশ্রী ভাষায় গালমন্দ করেন। এ কারণে ফাইজার ও তার বন্ধুরা উত্তেজিত হয়ে প্রতিহিংসাবশত এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে এজাহারে উল্লেখ করেন মৌমিতার বাবা। 

তিনি আরও বলেন, তার ছোট মেয়ে ঘটনার দিন বিকাল ৫টা ১৬ মিনিট থেকে ৫টা ২০ মিনিট পর্যন্ত মৌমিতার সঙ্গে মােবাইল ফোনে কথা বলে। সে জানতে পারে তার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছাদে আছে। আনুমানিক ৫টা ১৬ মিনিট থেকে ৬টার মধ্যবর্তী সময়ে আসামিরা পরস্পর যােগসাজশে ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে ভিকটিমকে বাসার ছাদের ওপর থেকে ফেলে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ফাইজার, আদনান, তানভীর, ত্রিনয়, আরও অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ ভূমিকা থাকতে পারে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যা বললেন
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক ঠাকুর দাস মালো ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নিহতের ঘটনায় সন্দেহজনকভাবে আমির হামজা আদনানকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মৌমিতার বাবা গত ১ মার্চ একটি হত্যা মামলা করেন। এরপর আদনানকে ওই হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদনসহ পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারক দুই দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। 

তিনি বলেন, ‘মামলার তদন্তে দেখা গেছে মৌমিতার সঙ্গে আসামি আদনানের সম্পর্ক ছিল। নিহত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে মৌমিতার সঙ্গে আদনানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়। মৌমিতা ও আদনানের ফোন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তারপরেও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। মৌমিতা কি নিজেই আত্মহত্যা করেছে, নাকি তাকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে, বিষয়টি তদন্ত শেষে বেরিয়ে আসবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ মামলার এজাহারে আদনান, ফাইজারসহ আরও কয়েকজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। মৌমিতা যে বাসায় ছিল ওই বাসা ফাইজারদের। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে তেমন কোনো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। তারপরেও সে নজরদারিতে রয়েছে। আর আদনান তো রিমান্ডে আছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যাবে, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কে জড়িত।’

আমির হামজা রিমান্ডে
এ ঘটনায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কলাবাগান থানা পুলিশ আমির হামজা আদনান নামে একজনকে গ্রেফতার করে। এরপর তাকে এই হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানোসহ পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৯ মার্চ আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

মঙ্গলবার (৯ মার্চ) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূর শুনানি শেষে রিমান্ডের এ আদেশ দেন। গত ২ মার্চ তদন্ত কর্মকর্তা আসামির পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক দুই দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।

এর আগে, ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে আদনানকে গ্রেফতার করা হয়। পরে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে বিচারক দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। দুই দিনের রিমান্ড শেষে ২ মার্চ ফের পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত আদনানের ফের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

মৌমিতার পরিবারের অভিযোগ
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর পড়ালেখার জন্য মা-বাবাসহ মালয়েশিয়ায় চলে যান মৌমিতা। কিন্তু করোনার কারণে গত বছরের ১৮ জুন দেশে আসেন। দেশে এসে ধানমন্ডির ওই বাসাটিতে ওঠেন।

পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে আসার পর থেকে ফাইজার বিভিন্ন সময় মৌমিতাকে উত্ত্যক্ত করত। ফাইজারের পরিবারকে এ বিষয়ে একাধিকবার অভিযোগ করা হলেও তারা কোনো প্রতিকার করেনি। উল্টো এ বিষয়ে ফাইজারের পরিবার ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে।

এ বিষয়ে মৌমিতার ফুপু শাহনেওয়াজ খানম ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, মৌমিতাকে ছাদে কিংবা সিঁড়িতে একা পেলেই ফাইজার তার বন্ধুদের নিয়ে উত্ত্যক্ত করত। ঘটনার দিন বিকেল ৪টায় মৌমিতা যখন ছাদে ওঠে তখন ফাইজার ও তার বন্ধুরা ছাদের গেট (দরজা) আটকে দেয় বলে আমরা জানতে পেরেছি। এরপরই মৌমিতার মরদেহ পাওয়া যায়। এছাড়া আশপাশের অনেক ভবনের লোকজন দেখেছিল, ঘটনার দিন বিকেল ৪-৬টা পর্যন্ত ছাদে অনেক লোকজন ছিল। কিন্তু পুলিশ ফাইজারকে আটক না করে তার বন্ধুকে আটক করেছে। ফাইজারকে আটক করলে সব তথ্য পাওয়া যাবে।

উল্লেখ্য, শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৪টায় ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডের বাসার ছাদে ওঠেন মৌমিতা। পরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিল্ডিংয়ের পেছনের গলিতে তাকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। উদ্ধার করে গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ময়নাতদন্ত শেষে মৌমিতার মরদেহ মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।

টিএইচ/ওএফ/এমএমজে