রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল ২০২০ সালের ২৭ মে। ওই অগ্নিকাণ্ডে মারা যান পাঁচ করোনা রোগী। সম্প্রতি হাসপাতালটির চেয়ারম্যান ও পরিচালকসহ রোগীদের প্রতি অবিচার করা চিকিৎসকদের ‘অব্যাহতি’র আবেদন করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। মর্মান্তিক ওই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় হাসপাতালটির অ্যাডমিন (প্রশাসন) ও এসি বিভাগের ছয়জনকে।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, দগ্ধ রোগীদের কোনো ধরনের উদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহণ না করে চরম গাফিলতি, অবহেলা, দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। করোনা সংক্রমণের ভয়ে চিকিৎসারত রোগীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি হাসপাতালের চিকিৎসক/সেবিকা এবং নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রোগীদের প্রতি চরম অবিচার করেছেন তারা। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয়টি হলো ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটের কোনো অনুমোদন ছিল না।

করোনা রোগীদের উদ্ধারে ‘চরম গাফিলতি, অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেওয়া’ এবং ‘ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটের অনুমোদন না থাকা’র পরও অভিযোগপত্র থেকে হাসপাতালটির চেয়ারম্যান ও পরিচালকসহ চিকিৎসকদের অব্যাহতির আবেদন মেনে নিতে পারেননি মামলার বাদী রোনাল্ড মিকি গোমেজ। তিনি আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে ‘অনাস্থা’ জানিয়ে নারাজির আবেদন করেছেন।

২০২০ সালের ২৭ মে ইউনাইটেড হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য অস্থায়ীভাবে নির্মিত আইসোলেশন ইউনিটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান পাঁচ করোনা রোগী। নিহতরা হলেন— মো. মাহবুব (৫০), মো. মনির হোসেন (৭৫), ভারুন এ্যান্থনী পল (৭৪), খাদেজা বেগম (৭০) ও রিয়াজউল আলম (৪৫)। তারা সবাই করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন

মামলার বাদী রোনাল্ড মিকি গোমেজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার এজাহারনামীয় সব আসামিকে অব্যাহতির আবেদন জানিয়ে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। আমরা এটার বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে আদালতে নারাজি আবেদন করেছি। এর আগে এ বিষয় নিয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে। সেখানে পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ছিল এবং তারা কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারেন না। সেখানে পুলিশ কীভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সবাইকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দাখিল করে?

আরও পড়ুন >> এক মৃতদেহে ‘আলো ফুটলো’ দুই প্রাণে

‘আমরা সবকিছু আদালতে তুলেছি। আদালত নথি পর্যালোচনা করে পুনরায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এখন দেখা যাক পিবিআই তদন্তে কী করে?’

২০২০ সালের ২৭ মে ইউনাইটেড হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য অস্থায়ীভাবে নির্মিত আইসোলেশন ইউনিটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান পাঁচ করোনা রোগী। নিহতরা হলেন— মো. মাহবুব (৫০), মো. মনির হোসেন (৭৫), ভারুন এ্যান্থনী পল (৭৪), খাদেজা বেগম (৭০) ও রিয়াজউল আলম (৪৫)। তারা সবাই করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন।

২০২০ সালের ৩ জুন হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ ছয়জনকে আসামি করে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন রোনাল্ড মিকি গোমেজ। তিনি অগ্নিকাণ্ডে নিহত এক ব্যক্তির আত্মীয়।

সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান থানার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) শেখ শাহানুর রহমান। সেখানে হাসপাতালটির প্রশাসন ও এসি বিভাগের ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা হলেন— হাসপাতালের প্রশাসন বিভাগে কর্মরত মো. খাদেমুল ইসলাম (৫১), মোহাম্মদ দাউদ আলী (৫১), এসি বিভাগে কর্মরত মো. আনোয়ার হোসেন (৫০), মো. লিমন মিয়া (৩৩), আমিনুর ইসলাম (৩১) ও মোহাম্মদ ফারুক হাওলাদার (৪৬)। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৩০৪-ক/১০৯ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হলো।

আরও পড়ুন >> ইউনাইটেডে আগুনে মৃত্যু : চার পরিবার পেল কোটি টাকা

অন্যদিকে, হাসপাতালের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরিদুর রহমান খান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান, পরিচালক আব্দুল আউয়াল মিন্টু, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও সেবিকা এবং নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় নিয়োজিত ছয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের মামলার দায় হতে অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে পাওয়া প্রতিবেদন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গঠিত তদন্ত কমিটির দেওয়া মতামতের বরাত দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। সেখানে বলা হয়, করোনা আইসোলেশন ইউনিট অগ্নি প্রতিরোধযোগ্য নির্মাণসামগ্রী দিয়ে তৈরি করা হয়নি। এছাড়া আইসোলেশন ইউনিটে আগুন নেভানোর জন্য কোনো ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সংযোজন ছিল না। অগ্নিকাণ্ড থেকে চিকিৎসারত রোগীদের রক্ষার ক্ষেত্রেও চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ধরনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ রোগীর মৃত্যুর দায় তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

‘ইউনাইটেড হাসপাতাল বিলাসবহুল এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় সেখানে দেশি-বিদেশি গণ্যমান্য ব্যক্তিরা চিকিৎসা নিতে আসেন। সেই বিবেচনায় হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারটি অস্থায়ী সরঞ্জামের পরিবর্তে অগ্নিপ্রতিরোধযোগ্য সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ করা উচিত ছিল। সেই সঙ্গে আইসোলেশন সেন্টারে সব ধরনের অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল।’

অগ্নিকাণ্ডের পর এজাহারনামীয় আসামিরা দুর্ঘটনা রুখতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বল্প সময়ে আলাদাভাবে আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণ করা সম্ভব নয়। এ কারণে হাসপাতালে অস্থায়ী অবকাঠামো স্থাপন করে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি অস্থায়ী আইসোলেশন সেন্টারটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশিক্ষিত কর্মচারী নিয়োগ দেন

অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, আইসোলেশন সেন্টারটি স্থাপনের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক হওয়ার উচিত ছিল বলে মনে করে তদন্ত কমিটি। এ ধরনের স্পর্শকাতর এলাকায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া আইসোলেশন সেন্টারটি নির্মাণ করা সমীচীন হয়নি। দুর্ঘটনার দিন এসি থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখামাত্র প্রাথমিকভাবে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে এতগুলো প্রাণহানি রোধ করা সম্ভব হতো। এছাড়া ইমার্জেন্সি অ্যালার্ম বাজানো, রোগীদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া এবং হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ দলকে জরুরিভাবে উপস্থিত হতে অনুরোধ জানালে রোগীদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হতো। এসি থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হতে দেখেও উপস্থিত চিকিৎসক, তিনজন সেবিকা ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা কার্যকর কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ করেননি বলে প্রতীয়মান হয়। ফলে সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে বলে মনে করে তদন্ত কমিটি।

আরও পড়ুন >> ইউনাইটেডে আগুন: প্রত্যেক পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ

উপস্থিত ছিলেন না অগ্নিনিরাপত্তা কর্মীরা

সিআইডির রাসায়নিক বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গঠিত তদন্ত কমিটির দেওয়া মতামতের বরাত দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের সময় অগ্নিনিরাপত্তা কর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। হাসপাতালের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে সার্বক্ষণিক ফায়ার সেফটি অফিসার ও অগ্নি নির্বাপণকারী দলের সদস্যদের উপস্থিত থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। হাসপাতালে আগুনে নেভানোর জন্য রাখা ফায়ার এক্সটিংগুইশার ঠিক মতো পুনঃভর্তি করা বেশ প্রয়োজনীয় ছিল।

যে কারণে হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ ছয়জনকে অব্যাহতির আবেদন

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, মামলার এজাহারনামীয় আসামি ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা, এমডি ফরিদুর রহমান খান, সিইও মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান, পরিচালক আব্দুল আউয়াল মিন্টু, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, সেবিকা এবং নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। এ কারণে মামলার দায় থেকে তাদের অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, অগ্নিকাণ্ডের পর এজাহারনামীয় আসামিরা দুর্ঘটনা রুখতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বল্প সময়ে আলাদাভাবে আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণ করা সম্ভব নয়। এ কারণে হাসপাতালে অস্থায়ী অবকাঠামো স্থাপন করে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি অস্থায়ী আইসোলেশন সেন্টারটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশিক্ষিত কর্মচারী নিয়োগ দেন।

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান থানার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) শেখ শাহানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তদন্ত করে যাদের দায়িত্বে অবহেলা পেয়েছি, তাদেরকেই অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছি। এজাহারে ইউনাইটেড হাসপাতালের মালিকপক্ষকে আসামি করা হয়েছে। তারা তো আর ডিউটি করেননি, যার যার দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। আমরা প্রকৃতপক্ষে যাদের গাফিলতি খুঁজে পেয়েছি তাদেরকে অভিযুক্ত করেছি।

এনআর/কেএ/এমএআর/