ঘটনাটি ২০১৫ সালের। মেয়ে পারুল আক্তারকে হত্যা করেন বাবা কুদ্দুছ। তবে এ হত্যার দায় চাপাতে চেয়েছিলেন মেয়ের স্বামীর ওপর। জামাইকে ফাঁসাতে ৮ বছর ধরে আইনি লড়াই লড়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে পিবিআইর হাতে ধরা পড়লেন তিনি।

পিবিআই জানায়, পারুলকে নিজ পছন্দে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বাবা আ. কুদ্দুছ খাঁ। কিন্তু ১০ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পারুল এলাকার প্রেমিক নাছির উদ্দিন বাবু নামে একজনের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেন। নিজের স্বপ্নভঙ্গের পাশাপাশি এমন কর্মকাণ্ডে সম্মানহানি হওয়ায় একপর্যায়ে মেয়ে পারুলকে খুন করেন বাবা কুদ্দুছ।

রোববার (২২ জানুয়ারি) এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ২০১৫ সালে নিজ হাতে মেয়েকে খুন করে মেয়ের জামাইকে ফাঁসাতে দায়েরকৃত মামলায় বেরিয়ে আসে হত্যার রহস্য। কুদ্দুছ খাঁ তার মেয়ে পারুলের ইতোপূর্বের কার্যকলাপের অপমানবোধ থেকে এ খুন করেন। খুনের পর সে ভাবতে থাকেন তার এ অপমানের জন্য নাছিরও দায়ী। তিনি চেয়েছিলেন নাছিরের যেন ফাঁসি হয়। তাই তিনি বারবার মামলার তদন্তে না-রাজি দিচ্ছিলেন।

প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কুদ্দুছ একজন সচ্ছল কৃষক ছিলেন। কিন্তু মামলা চালাতে গিয়ে তার জমিজমা বিক্রি করে দেন। এখন শুধুমাত্র তার ভিটাবাড়ি রয়েছে। মেয়েকে হত্যা করলেও মেয়ের জামাই নাছিরকে ফাঁসিতে না চড়াতে পারলে তার শান্তি হচ্ছিল না। তাই তিনি বারবার না-রাজি দিয়ে মামলা চালিয়ে আসছিলেন।

ঘটনার সূত্রপাত জানতে চাইলে পিবিআই জানায়, ২০১২ সালে ১০ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পাশের গ্রামের নাছিরের সঙ্গে পারুলের প্রেমের সম্পর্ক হয়। নাছিরের সৌদি প্রবাসী বাবা পারুলের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলে কুদ্দুছ খাঁ রাজি হননি। এর মধ্যে একদিন সকালে প্রাইভেটের কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি পারুল। পরদিন বাবা কুদ্দুছ তার মেয়ে নিখোঁজের বিষয়ে কালিহাতি থানায় একটি জিডি করেন। যদিও গ্রামের সবাই জানতো পারুল নাসিরের সঙ্গেই পালিয়ে গেছেন। পারুল নাছিরের সঙ্গে পালিয়ে ঢাকার আশুলিয়ায় এসে বিয়ে করেন। পরিবার বিয়ে মেনে না নেওয়ায় তারা ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়ায় ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। তারা পোশাক কারখানায় চাকরি নিলেও একপর্যায়ে সংসারে অশান্তি শুরু হয়।

বিয়ের ৩ বছর পর ২০১৫ সালে পারুল তার বাবাকে ফোন করে অশান্তির কথা জানায়। কুদ্দুছ পারুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত হওয়ার ভাণ ধরেন। এক পর্যায়ে মেয়েকে ভালো ছেলে দেখে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে উন্নত জীবন-যাপনের লোভ দেখিয়ে তার মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

২০১৫ সালের ১৯ জুলাই কুদ্দুছ তার মেয়েকে বন্ধু মোকা মন্ডলের বাড়ি ভূঞাপুরে নিয়ে যায়। মোকা মণ্ডল ভবিষ্যতে পারুলকে প্রতিষ্ঠিত করবে এ আশ্বাসে তারা জয়পুরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।

জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকায় বাস থেকে নেমে পারুলকে নিয়ে হাঁটতে থাকেন কুদ্দুছ ও মোকা মন্ডল। রাতের বেলা তুলসী গঙ্গা নদীর পাশে একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে পারুলকে তার বাবা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। কুদ্দুছ ও মোকা মন্ডল পারুলের ওড়না ২ ভাগ করে তার হাত ও পা বাঁধেন। এরপর মোকা মন্ডলের সহযোগিতায় পারুলের গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেন বাবা কুদ্দুছ। এরপর বন্ধু মোকা মন্ডলকে নিয়ে টাঙ্গাইলের বাড়িতে ফিরে যান কুদ্দুছ।

জামাইকে ফাঁসাতে একের পর এক মামলায় না-রাজি

পিবিআই জানায়, মেয়েকে হত্যার পর ২০১৫ সালের ৪ আগস্ট নাছির উদ্দিনের পরিবারের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলের আদালতে মেয়েকে অপহরণ করে গুমের মামলা দায়ের করেন। মামলাটি আদালতের নির্দেশে কালিহাতি থানায় নথিভুক্ত করা হয়। প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করে প্রেম করে বিয়ে করার সংশ্লিষ্টতা পায়। কিন্তু ভিকটিম পারুলকে না পওয়ায় ঘটনাস্থলে তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত এলাকা ঢাকায় মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করে। বাদী কুদ্দুছের না-রাজির প্রেক্ষিতে ডিবি পুলিশ, টাঙ্গাইল পিবিআই, টাঙ্গাইল সিআইডি তদন্ত করে একই রিপোর্ট দেয়।

২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর কুদ্দুছ খাঁ ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আদালতে পারুলের স্বামীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন দমন আইনে যৌতুকের জন্য মারপিট করে হত্যা মামলার আবেদন করেন। এরপর ৩০ নভেম্বর আদালত আশুলিয়া থানাকে মামলা রুজু এবং পিবিআই ঢাকা জেলাকে তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর পিবিআই ঢাকা জেলা মামলাটির তদন্ত শুরু করে।

যেভাবে রহস্যের উদঘাটন

পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) বিশ্বজিৎ বিশ্বাস তদন্তে নেমে প্রথমে নাছির উদ্দিনকে ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে গ্রেপ্তার করেন। আদালতের নির্দেশে নাছিরকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, ডাকা হয় বাদী কুদ্দুছকেও।

জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে কুদ্দুছ জানায়, মনে হচ্ছে তার মেয়ে বেঁচে আছেন। বিভিন্ন অসংলগ্ন কথাবার্তার মধ্যেই তিনি জানান, পারুলকে রেখে এসেছেন বন্ধু মোকা মন্ডলের বাড়িতে। এরপর মোকা মন্ডলের খোঁজ করা হলে, কুদ্দুছ নিজের মেয়েকে বন্ধু মোকা মন্ডলের সহায়তায় হত্যার কথা স্বীকার করেন।

এদিকে, পিবিআইর পক্ষ থেকে পাঁচবিবি থানায় যোগাযোগ করা হলে সে সময় এমন একটি তরুণীর মরদেহ উদ্ধারের কথা জানায়, মরদেহের বর্ণনার সঙ্গে কুদ্দুছের বর্ণনা মিলে যায় এবং ছবির সঙ্গেও মিলে যায়।

অবশেষে শুক্রবার (২০ জানুয়ারি) মেয়েকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বাবা। এ ঘটনায় কুদ্দুছের বন্ধু মোকা মন্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রোববার ২২ জানুয়ারি তাকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির জন্য আদালতে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান বনজ কুমার।

তিনি বলেন, নাছিরকে গত ১৯ জানুয়ারি রিমান্ড শেষে জেলে পাঠানো হয়েছে। সে জামিন চাইলে পিবিআই তাকে সাহায্য করবে। মামলার বাকি প্রক্রিয়া শেষে তিনি নিশ্চয়ই মুক্তি পাবেন।

এআর/এফকে