দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে আদালত বলেছেন, এদেশ কি হরিলুটের জায়গা? যেখানে ছলেবলে ও কৌশলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে কি টাকা নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে, আমরা কি এটা অ্যালাও (অনুমোদন) করতে পারি? এদেশ হরিলুটের জায়গা হতে পারে না।

সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) ‘জি.বি হোসেন বনাম দুদক এবং অন্যান্য’ মামলার শুনানিকালে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

গাজী বেলায়েত হোসেন যিনি জি.বি হোসেন নামে পরিচিত। তিনি দুটি পাসপোর্টের অধিকারী। একটি বাংলাদেশের ও আরেকটি কানাডার। নিজেকে পরিচয় দেন জাহাজ ব্যবসায়ী হিসেবে। জাহাজ আমদানি করবেন বলে রাষ্ট্রয়াত্ত বেসিক ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ নেন। কিন্তু সেই ঋণের অর্থে জাহাজ আমদানি তো দূরের কথা পুরো টাকাই তিনি কানাডায় পাচার করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

২০১৯ সালে জি.বি হোসেনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। সেই নিষেধাজ্ঞার আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। ওই রিটের ওপর শুনানি নিয়ে তাকে বিদেশ যেতে অনুমতি দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি রুল জারি করেন।

আজ (সোমবার) ওই রুলের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে দ্বৈত নাগরিকদের দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি উঠে আসে। 

শুনানিতে দুদক আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, বিদেশে অর্থ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা নির্দেশনা রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, যদি কেউ পাঁচ বছরের ভিসা পান তাহলে তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে ১২ হাজার মার্কিন ডলার নিতে পারবেন। এর চেয়ে কম সময়ের ভিসা পেলে ১০ হাজার ডলার নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই ব্যাক্তি পুরো টাকাটাই কানাডায় পাচার করেছেন। 

এ পর্যায়ে আদালত বলেন, এদেশ কি হরিলুটের জায়গা? উনি তো দ্বৈত নাগরিক। সে কি এভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে নিয়ে যেতে পারেন?

দুদক আইনজীবী বলেন, ওই ব্যক্তি কিছু কাল্পনিক ডকুমেন্টস দিয়ে ঋণ নিয়েছেন। আদালত বলেন, দ্বৈত নাগরিকদের হার্ট (হৃদয়) তো দুটি। কারণ তারা দুই দেশের নাগরিক। ঋণের টাকা বিদেশে নিয়ে গেলে সেটা এদেশে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে ভীনদেশে সেটা অপরাধ হিসাবে বিবেচিত নাও হতে পারে। 

তখন দুদক কৌসুলি বলেন, বিশ্বের কোনো দেশই অনুমোদন দেবে না। গত এক বছরে কানাডাও তাদের আইনে পরিবর্তন এনেছে। ফলে এখন সেখানে ইচ্ছেমতো বাড়ি কেনা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, কুয়েতে বাংলাদেশের এমপি পাপুলের সাজা হয়েছে। এই ইস্যুতে কুয়েতি দূতাবাস অনেক কাজ করেছে। ফলে সেদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে অর্থ আসা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে।

হাইকোর্ট বলেন, শুধু মামলা করে ও বক্তব্য দিয়ে কাজ হবে না। অর্থপাচার রোধ করতে নানা কৌশল গ্রহণ করতে হবে। যেমনটা ভারত সরকার করেছে। সেখান থেকে যারা অর্থপাচার করে সরকার সেই পাচারকৃত অর্থের ওপর ট্যাক্স কেটে নেয়। 

দুদক কৌসুলি বলেন, আমাদের এখানেও কাজ চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বলেন, কতদিন ধরে কাজ চলবে? আমরা শুধু শুনেই যাচ্ছি কাজ চলছে।

জি.বি. হোসেনের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, উনি কানাডার নাগরিক হলেও বিদেশে তার অর্থ নিয়ে যেতে বাধা নেই। শুধুমাত্র দ্বৈত নাগরিকরা সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে পারবেন না। তবে বিদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করলে তখন এমপি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, প্রতিটি দেশেই নাগরিকত্ব আইন আছে। ইমিগ্রেশনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বিদেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন। প্রথমে বিবাহ সূত্রে, দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক আশ্রয়ের মাধ্যমে ও বর্তমানে বিনিয়োগ ক্যাটাগরিতে নাগরিকত্ব পাচ্ছেন অনেকেই। 

তিনি বলেন, যখন ব্যাংকগুলোতে পলিটিক্যাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট হচ্ছে, তখন থেকেই লুটপাট শুরু হয়েছে। দেশ থেকে বেরিয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। আর এই লুটপাটের টাকা দিয়েই বিদেশে কেউ বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব অর্জন করছেন। বাড়ি কিনছেন। আদালত এ বিষয়ে একটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করতে পারেন। 

হাইকোর্ট বলেন, যিনি দ্বৈত নাগরিক, ঋণ আবেদন দেওয়ার সময় এ বিষয়ে ঘোষণা থাকা দরকার। দ্বৈত নাগরিক হলেও তো তার ঋণ নিতে কোনো আইনগত বাধা নাই। আর ঋণের অর্থপাচার করলে তো ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মানি লন্ডারিং আইন রয়েছে।

দুদক আইনজীবী বলেন, বেসিক ব্যাংকের অর্থ বিদেশে পাচার নিয়ে আদালতের ওই ব্যাংকের বক্তব্য শোনা উচিত। কেন তারা একজন দ্বৈত নাগরিককে এত টাকা ঋণ দিলো? এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও বক্তব্য আদালত শুনতে পারেন। কারণ দ্বৈত নাগরিকদের ঋণ মঞ্জুরের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নির্দেশনা বা নীতিমালা রয়েছে কি না!

এরপরই এ বিষয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন হাইকোর্ট। ওইদিন রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য শুনবেন আদালত।

এমএইচডি/কেএ