শিবগঞ্জ পাট ক্রয় কেন্দ্রের জমি বিক্রির কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশ
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শিবগঞ্জে জুট ট্রেডিং করপোরেশনের (জেটিসি) অধীন ‘পাট ক্রয় কেন্দ্র’র জমি নামমাত্র মূল্যে বিক্রির কার্যক্রম ছয় মাসের জন্য স্থগিতের আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে পাট ক্রয় কেন্দ্রের জমি নামমাত্র মূল্যে বিক্রির সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
সোমবার (১৬ অক্টোবর) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। পাট মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার বিভূতি তরফদার। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ।
এর আগে, গতকাল (রোববার) শিবগঞ্জ পাট ক্রয় কেন্দ্রের জমি নামমাত্র মূল্যে বিক্রির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন ঠাকুরগাঁওয়ের আইনজীবী আব্দুস সামাদ।
বিজ্ঞাপন
গত ১১ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘পানির দরে বিক্রি হচ্ছে পাট ক্রয় কেন্দ্রের জমি, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ’— শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে হাইকোর্ট রিট দায়ের করা হয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শিবগঞ্জে জুট ট্রেডিং করপোরেশনের (জেটিসি) অধীন পাট ক্রয় কেন্দ্রের ৫৪ শতক জমি নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে ওই জমির আনুমানিক বাজার মূল্য ৩ কোটি টাকা। তবে তা ৩১ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় হস্তান্তরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি জানাজানির পরও জমি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
জানা যায়, ১৯৭৪ সালের ২৯ জুন ৪৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যে শিবগঞ্জে পাট ক্রয় কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ৫৪ শতক জমি কেনে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত জেটিসি। জেটিসির অধীনে পরিচালিত সব পাট ক্রয় কেন্দ্র ২০০০ সালের দিকে বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। একপর্যায়ে দেশের পাট শিল্পে মন্দা দেখা দিলে কেন্দ্রগুলো অব্যবহৃত হতে শুরু করে।
এর মধ্যেই পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে কেন্দ্রগুলো বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শিবগঞ্জে টেন্ডার শেষে ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর ৩১ দশমিক ৭৬ লাখ টাকা মূল্যে স্থানীয় ব্যবসায়ী রাজিউল ইসলামের কাছে ওই ৫৪ শতক সম্পত্তি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। সেই লক্ষ্যে এ বিষয়ে ইচ্ছাপত্র ইস্যু করা হয়।
শিবগঞ্জের ওই জমি বিক্রি সংক্রান্ত টেন্ডার এবং ইচ্ছাপত্র থেকে জানা যায়, বিক্রির শর্তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চুক্তির পুরো অর্থ ৩ কিস্তিতে ইচ্ছাপত্র ইস্যুর তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর একটি মাত্র কিস্তিতে মোট অঙ্কের ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ৮ লাখ টাকা দেন ব্যবসায়ী রাজিউল। এরপর আর অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ করেনি তিনি।
কিস্তি পরিশোধ না করায় প্রায় ৪ মাস পর ২০১২ সালের ১২ এপ্রিল পাট কেন্দ্রের ওই জমি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। দীর্ঘদিন পর চলতি বছরের ২৬ জুলাই ইচ্ছাপত্রে উল্লিখিত অর্থের অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ টাকা পরিশোধের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেন রাজিউর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, পাট ক্রয় কেন্দ্রটি ২০১১ সালের জুলাই মাসে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। পরে ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর ওই জমি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গেজেটে প্রকাশিত হয় এবং আরও পরে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা থেকে অবমুক্ত হয়। এরপর আপিল করা হলে ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর তা খারিজ করে দেন আদালত। ওই সম্পত্তির মালিকানা পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুনর্বহাল থাকে। এই অবমুক্তির চিঠি গত সপ্তাহে পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তারাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
ব্যবসায়ী রাজিউল ইসলাম অবশিষ্ট টাকা পরিশোধের জন্য আবেদনের তথ্য স্বীকার করে বলেন, অর্পিত সম্পত্তির মামলার কারণে আগে অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ করা হয়নি।
টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী টাকা পরিশোধের যে সময়সীমা ছিল, এরপরেই ওই জমিকে অর্পিত সম্পত্তি দেখিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। তবে কেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ করেননি, এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি রাজিউল ইসলাম।
এদিকে, পাট চাষে পুনরায় গতি ফিরে আসায় এবং দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় জেলায় বেশ কয়েকটি পাটকল বেসরকারিভাবে পরিচালিত হয়ে লাভজনক অবস্থানে আসায় পাট ক্রয় কেন্দ্রের জমিটি নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তরের বিরোধিতা করছেন এ অঞ্চলের চাষি ও পাট ব্যবসায়ীরা।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মাদারগঞ্জ এলাকার চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, পাট ক্রয় কেন্দ্রটি চালু থাকলে পাটের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আবুল কাসেম বলেন, মূল্যবান এই সরকারি সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তর না করে, পুনরায় কেন্দ্রটি চালু করে পাট ক্রয়ের উদ্যোগ নিলে একদিকে যেমন পাট চাষিরা ন্যায্যমূল্য পাবেন, অন্যদিকে এই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যও গতিশীল হবে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে ওই এলাকার অন্য এক ব্যবসায়ী বলেন, সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের এত দামি জমি যদি বিক্রি করতেই হয়, তবে আবার টেন্ডার আহ্বান করে চলতি বাজার মূল্যে ওই জমি বিক্রি করলে সরকারের কোষাগারে কয়েকগুণ বেশি টাকা জমা হবে।
ঠাকুরগাঁওয়ের পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা অসীম কুমার মালাকার বলেন, চাহিদা ও ভালো বাজার মূল্যের কারণে এই এলাকায় পাট চাষে কৃষকরা আবার আগ্রহী হয়ে উঠছেন। জেলায় গত কয়েক বছর ধরে গড়ে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে পাট চাষ হচ্ছে। পাট ক্রয় কেন্দ্রটি চালু হলে ভালো বাজার মূল্যে পাট বিক্রির নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে।
এমএইচডি/কেএ