সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু

অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু শুধু আইনপেশায় নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ১৯৫০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মিরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মো. আবদুল মালেক এবং মাতা জাহানারা বেগম। তারা চার ভাই, এক বোন। আব্দুল মতিন খসরু ব্যক্তিজীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক।

আব্দুল মতিন খসরু ১৯৭৮ সালে কুমিল্লা জজকোর্টে যোগদান করেন। ১৯৮২ সাল থেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে নিয়মিত প্র্যাকটিস শুরু করেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং কুমিল্লা জেলার অবিভক্ত বুডিচং থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। 

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে তার করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা ডি.এল.আরসহ (DLR) বিভিন্ন ‘ল’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আইনপেশার পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন তিনি। এর আগে তিনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের থানা ও জেলার বিভিন্ন পদে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। 

আব্দুল মতিন খসরু ৫ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৯১-১৯৯৬, ১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৪, ২০১৪-২০১৮ ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন। 

১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল মতিন খসরু। তিনি আইনমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৬ সালে সংবিধান ও মানবতা বিরোধী কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যবস্থা করেন, যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের আত্মস্বীকৃত খুনীদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়। 

তিনি ২০০০ সালে মিশরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত আফ্রিকান-এশিয়ান লিগ্যাল কনফারেন্স অব দ্য এশিয়ান পলিটিক্যাল পার্টিস কনসাল্টেটিভ কমিটির (AALCC) সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান রাজনৈতিক দল সমূহের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব এশিয়ান পলিটিক্যাল পার্টিস-এর ( ICAPP) সহসভাপতি নির্বাচিত হন, যে সম্মেলনে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

মৃত্যুর আগে আব্দুল মতিন খসরু মেম্বর স্ট্যান্ডিং কমিটি অব আইসিএপিপি-এর দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ২০১৩ সালে চীনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইকোলজিক্যাল সেফটি কোলাবোরেটিভ অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে সিনিয়র অ্যাডভাইজার অ্যান্ড ডেপুটি ডিরেক্টর অব লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স কমিটি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

১০ম জাতীয় সংসদের অনুমিত হিসেব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্বসহ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে গুরু দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল মতিন খসরু। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রতিবন্ধী বিষয়ক সংসদীয় মোর্চার (CAUCAS) আহ্বায়ক। 

এছাড়াও তিনি নিউইয়র্ক ভিত্তিক পার্লামেন্টারি সংগঠন পার্লামেন্টারির অন্যতম সদস্য হিসেবে আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সেমিনারে যোগদান করেছেন। এসব সেমিনারে তিনি বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। 

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি All Party Parliamentary Caucus on Population Management-এর কনভেনর নির্বাচিত হন। 

বাংলাদেশের বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থাকে আমূল সংস্কার ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে তিনি আইনমন্ত্রী থাকাকালীন বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ লিগ্যাল অ্যান্ড জুডিশিয়াল ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রোজেক্ট নামে ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এনেক্স ভবন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ভবন নির্মাণের সমূদয় পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন, যা পরবর্তীতে বাস্তবায়িত হয়। 

হাইকোর্টের মূল ভবন ও পুরাতন ভবনের মধ্যে যাতায়াত সুবিধার জন্য একটি গ্যাংওয়ের নির্মাণ করেন তিনি। সুপ্রিম কোর্ট এনেক্স ভবনসহ সারা বাংলাদেশে বিচারালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেন। 

বার কাউন্সিলের সদস্য থাকাকালে তিনি আইনজীবীদের কল্যাণে ১৫ তলা বিশিষ্ট একটি আধুনিক ভবন নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা বর্তমানে নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নির্বাচনে তিনি সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং ২০১৫ সালে পুনরায় বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। সর্বশেষ গত ১০ ও ১১ মার্চ বাংলাদেশ  সুপ্রিম কোর্ট কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু স্বশরীরে দায়িত্ব পালনের আগেই তিনি আজ (১৪ এপ্রিল) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন

এমএইচডি/এইচকে