স্বয়ং বিচারপতি হাত হারানো দরিদ্র পরিবারের ১৩ বছরের শিশুকে কাছে ডেকে নিলেন। হাতে তুলে দিলেন চকলেট। শিশুকে আদর মাখা কণ্ঠে বললেন, ভালোভাবে পড়ালেখা করে বড় অফিসার হবে। আমরা যখন বুড়ো হব, দেখা করতে আসবে। আমরা অপেক্ষায় থাকব। এ দৃশ্য বিদেশের কোনো আদালতের নয়। দেশের উচ্চ আদালতে বুধবার (৩১ জানুয়ারি) এ দৃশ্যের অবতারণা হয়।

২০২০ সালে ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে হাত হারান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার ১৩ বছর বয়সী শিশু নাঈম হাসান নাহিদ। ওই বছর ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করেন শিশুটির বাবা। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেছিলেন। আজ ছিল চূড়ান্ত রায় ঘোষণার দিন।

বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাতের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে হাত হারানো শিশু নাইমের নামে ৩০ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি শিশুটিকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনার খরচ হিসেবে প্রতি মাসে ৭ হাজার টাকা করে দিতে বলা হয়।

রায় ঘোষণা শেষে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নাইমা হায়দার শিশু নাঈমকে কাছে ডাকেন। শিশুকে আদরমাখা কণ্ঠে বলেন, ‘তুমি আর দুষ্টুমি করবে না। ভালোভাবে পড়াশোনা করবে।’ শিশু নাঈম মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়।

বিচারপতি বলেন, ‘এই চকলেটগুলো নাও। চকলেট শুধু তোমার জন্য।’ বিচারপতি নাইমা হায়দার বলেন, ‘আমরা কিন্তু তোমার পড়াশোনার খোঁজ নেব। যখন বুড়ো হব, বড় অফিসার হয়ে দেখা করতে আসবে। ভালো থেকো।’

রায়ের পর আইনি লড়াইয়ে বিজয়ের আনন্দে শিশুটির বাবা আইনজীবীদের জড়িয়ে ধরে কান্না করেন। শিশু নাঈমও হাউমাউ করে কান্না করেন। এসময় এক আবেগঘন দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।

রায় ঘোষণার আগে হাইকোর্ট বলেন, আমরা শিশুটির পড়াশোনা ও কল্যাণের কথা চিন্তা করে রায় দিচ্ছি। রায়ে ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে তিন বছর আগে হাত হারানো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার ১৩ বছর বয়সী শিশু নাঈম হাসান নাহিদকে ৩০ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যে ১৫ লাখ টাকার ডিপোজিট এবং ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ১৫ লাখ টাকার ডিপোজিট করতে হবে। ১০ পছর পর নাঈম হাসান নাহিদ ডিপোজিটের টাকা উত্তোলন করতে পারবে। আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের যাত্রাবাড়ী শাখায় ফিক্সড ডিপোজিট করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে শিশুটি এইচএসসি পাস না করা পর্যন্ত পড়াশোনার খরচ হিসেবে তাকে প্রতি মাসে ৭ হাজার টাকা করে দিতে বলা হয়েছে। ভৈরবের নূর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিককে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, এ রিট মামলা চলমান থাকবে।

এ বিষয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে বুধবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার অনীক আর হক ও অ্যাডভোকেট মো. বাকির উদ্দিন ভূইয়া। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী তামজিদ হাসান। তারা বিনা পয়সায় শিশুটির পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন।

ওয়ার্কশপ মালিকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও আইনজীবী আবদুল বারেক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত।

এর আগে গত ৫ ডিসেম্বর শিশু নাঈম হাসানকে ক্ষতিপূরণ দিতে রুলের ওপর শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।

‘ভৈরবে শিশুশ্রমের করুণ পরিণতি’ শিরোনামে ২০২০ সালের ১ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তখন নাঈম হাসানের বয়স ১০ বছর। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা গ্রামে। তার বাবা আনোয়ার হোসেনের পেশা জুতার ব্যবসা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর সময়ে আনোয়ার কর্মহীন হয়ে পড়েন। এসময় সংসারের চাপ সামলাতে নাঈমকে তার মা-বাবা কিশোরগঞ্জের ভৈরবের একটি ওয়ার্কশপে কাজে দেন। ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে তার ডান হাতটি মেশিনে ঢুকে যায়। শেষে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় ডান হাতটি।

প্রকাশিত প্রতিবেদনটি যুক্ত করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশনা চেয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শিশুটির বাবা হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে শিশুটিকে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। চার সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়। একইসঙ্গে ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের ওই ঘটনা নিজ কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা দিয়ে অনুসন্ধান করতে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়। আগের ধারাবাহিকতায় রুলের ওপর শুনানি হয়।

এমএইচডি/এসএসএইচ