সাত মাস আগে সন্তানদের খোঁজে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আসেন মার্কিন নাগরিক গ্যারিসন ‍লুটেল। সন্তানদের সন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে হেবিয়ার্স কর্পাস রিট করেন। উচ্চ আদালত গ্যারিসনকে সন্তানদের দেখাশোনার করার সুযোগ করে দেন। এখন সন্তানদের অভিভাবকত্ব ও জিম্মা নিয়ে মামলা চলছে ঢাকার পারিবারিক আদালতে।

সন্তানদের টানে গ্যারিসনকে এখন বাংলাদেশে থাকতে হচ্ছে। সাত মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে তিনি এ দেশের মানুষের প্রেমে পড়ে গেছেন। তাই এ দেশেই থাকতে চান। শুধু তাই নয়, ব্যবসায়ী গ্যারিসন চ্যারিটি সংগঠন করে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান। বাংলাদেশের ট্যুরিজমকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চান। এ লক্ষ্য সামনে রেখে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন তিনি। এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন মার্কিন নাগরিক গ্যারিসন ও তার আইনজীবী ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ আলম।

ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ বলেন, গ্যারিসন বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছেন। মিশতে মিশতে বাংলাদেশের মানুষের প্রেমে পড়েছেন। হাইকোর্টে মামলার পর থেকে তাকে রাস্তাঘাটে যেভাবে মানুষ সমর্থন করে, এটা গ্যারিসনের ভালো লেগেছে। এই সমর্থন তিনি নিজের দেশেও পাননি। এখানে এই সমর্থনটা তার ভালো লাগে। গ্যারিসন  বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকতে চান। যেহেতু সেখানে তার মা-বাবা আছেন। মামলার কারণে তাকে বাংলাদেশে থাকতে হচ্ছে।

এই আইনজীবী বলেন, তিনি একটা নট ফর প্রফিট অরগানাইজেশন করার কাজ শুরু করেছেন। তার এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য হবে বিদেশে যারা আছেন তারা যেন বাংলাদেশে ট্যুরিজমের জন্য আসেনি। শুধু বিদেশিরা এসে কক্সবাজার, ইনানি বিচ, খাগড়াছড়ি দেখে চলে গেল, এরকম না। গ্যারিসনের প্রতিষ্ঠান কিছু মাদ্রাসা, কিছু এতিমখানা, কিছু মসজিদ, মন্দির, দর্শনীয় স্থানকে স্পন্সর করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধরুন কেউ বিদেশ থেকে এলেন, তিনি হয়ত কিশোরগঞ্জের একটি বড় এতিমখানা দেখতে গেলেন। ওই বিদেশি এতিমখানার বাচ্চাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটালেন, গ্রামে থাকলেন। এতে তার ট্যুরিজমটা হলো। আবার যে কমিউনিটিতে এলেন কমিউনিটির কিছু উন্নয়ন হলো। এ বিষয়গুলো গ্যারিসন প্রমোট করতে চাইছেন।

এ বিষয়ে গ্যারিসন লুটেল বলেন, বাংলাদেশ আমার ভালো লাগে। এ দেশের মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছি। এ দেশকে সেকেন্ড হোম মনে করি। এখানে চ্যারিটি সংগঠন করে কাজ করতে চাই।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি দুই সন্তানের জিম্মা নিয়ে মার্কিন বাবা গ্যারিসন লুটেল ও বাংলাদেশি মা ফারহানা করিমের মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ঢাকার পারিবারিক আদালতকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে আমেরিকান বাবা গ্যারিসন লুটেল সপ্তাহে দুই দিন তার দুই সন্তানকে দেখতে যেতে পারবেন বলে আদেশে বলা হয়েছে। বাবা-মায়ের সুবিধাজনক স্থানে দেখার স্থান নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।

বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। সেদিন আদালতে গ্যারিসনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ও ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ আলম। ফারহানা করিমের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।

তার আগে গত বছরের ২৮ নভেম্বর মার্কিন বাবা গ্যারিসন লুটেল সপ্তাহে দুই দিন সন্তানদের দেখতে পারবেন বলে আদেশ দেন হাইকোর্ট। ঢাকার উত্তরা ক্লাবে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার শিশুর মা ফারহানা করিম শিশুকে নিয়ে আসবেন। সেখানে বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শিশু মায়ের তত্ত্বাবধানেই থাকবেন। সেখানে বাবা গ্যারিসন লুটেল সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন।

বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের  হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছিলেন। সেদিন মার্কিন বাবা গ্যারিসন লুটেল ও বাংলাদেশি মা ফারহানা করিমে বক্তব্য শোনেন আদালত। রুদ্ধদ্বার কক্ষে তাদের বক্তব্য শোনা হয়।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন সন্তানদের কোনো খোঁজ-খবর না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ছুটে আসেন গ্যারিসন। বাংলাদেশে এসে সন্তানদের আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন তিনি। রিটের শুনানি নিয়ে দুই শিশু সন্তানসহ তাদের বাংলাদেশি মা ফারহানা করিমকে আদালতে হাজির করতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। উত্তরা থানা পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।

পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্যবসায়ী গ্যারিসন লুটেল। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফারহানা করিমকে ২০১৮ সালে বিয়ে করেন। ঢাকার উত্তরাতে তাদের বাসা। ফারহানা স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাস করেন। তিন বছর আগে তাদের প্রথম একটি সন্তান হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ফারহানা ও গ্যারিসনের নিজস্ব বাসা ছিল। এ বছরের শুরুর দিকে ফারহানা আবার অন্তঃসত্ত্বা হন। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় জুন মাসে ফারহানা করিম বাংলাদেশে চলে আসেন। অন্তঃসত্ত্বার সময় তার বোন-মায়ের সঙ্গে থাকা জরুরি– এই অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশে আসেন। আসার পর তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। সন্তানদের কথা চিন্তা করে গ্যারিসন ফারহানাকে নিয়মিত টাকা দিয়ে আসছিলেন।

কিন্তু পরে দেখলেন, অনেকদিন হয়ে গেছে যোগাযোগ করছে না। কোনো আপডেট দিচ্ছে না। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তিনি চেষ্টা করেছেন যোগাযোগ করতে কিন্তু পারেননি। যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে অক্টোবর মাসে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশে আসার পর গ্যারিসন যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু ফারহানা দেখা করতে চান না, বাচ্চাদেরও দেখাতে চান না। একপর্যায়ে উত্তরা থানার পুলিশ ও গ্যারিসন যে হোটেলে থাকতেন তাদের সহযোগিতা নিয়ে ফারহানার বাসায় যান। বাসায় গিয়ে জানতে পারেন, ফারহানা করিম কানাডিয়ান একজন ব্যক্তির সঙ্গে বসবাস করছেন। তিনি কানাডিয়ান ওই ব্যক্তিকে বিয়ে করেছেন বলে দাবি করেন। এদিকে এক মাস আগে আরেকটি ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েছেন ফারহানা।

আইনজীবী বলেন, সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, তিনি গ্যারিসনকে হাসপাতালের কাগজ দেখিয়ে বলেছেন দ্বিতীয় সন্তান গ্যারিসনের নয়। এ সন্তান তার পার্টনার কানাডিয়ান নাগরিকের। তিনি একটা ম্যারেজ ডকুমেন্ট দেখিয়ে বলেছেন, কানাডিয়ান নাগরিককে বিয়ে করেছেন। কিন্তু আমেরিকান নাগরিক গ্যারিসনের সঙ্গে তার এখনো ডিভোর্স হয়নি। গ্যারিসনের বাংলাদেশে আসার অন্যতম কারণ– পুরান ঢাকার একজন কাজী যুক্তরাষ্ট্রে একটি কাগজ পাঠায়। সেটি তালাকের নোটিশ। মুসলিম পারিবারিক আইনে একটি তালাকের নোটিশ পাঠান। নোটিশ দেখে গ্যারিসনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ বলেন, আমরা আদালতে বলেছি, নোটিশটা ইনভ্যালিড। কারণ তাদের বিয়ে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট অব মিজোরির আইন অনুযায়ী। ডিভোর্স হলে স্টেট আইনে হতে হবে।

বাংলাদেশে আসার পর গ্যারিসন উত্তর সিটি কর্পোরেশনে যান। সিটি কর্পোরেশন থেকে কাগজপত্র দেখে তারা বলেন, আসলে এটা তো এভাবে হয় না। আমরা তারপর কাজীর কাছে গিয়েছি। তিনি খুব বেশি সহযোগিতা করেননি। তিনি আমাদের থেকে একটি দরখাস্ত রেখেছেন। বিয়ে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী। অথচ তিনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন মুসলিম পারিবারিক আইনে, এটা তিনি আইনত পারেন না। আর নোটিশ যখন ইস্যু করা হয়েছে তখন ফারহানা অন্তঃসত্ত্বা।

তিনি বলেন, অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় তো নোটিশ পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। নোটিশের বিষয়ে তিনি দেওয়ানি মামলা করেছেন। আর সন্তানদের হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে হেবিয়ার্স কর্পাস রিট করা হয়েছে।

এমএইচডি/এসএসএইচ