রায়ের পর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছেন এক আসামি/ ছবির কোলাজ- ঢাকা পোস্ট

২০১৭ সালে ১৫ লাখ পিস ইয়াবাসহ র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন ১২ ব্যক্তি। এরপর থেকে তারা জেলে আছেন। ইতোমধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিরা জেল থেকে ছাড়া পেতে কোনো আইনজীবী নিয়োগ দেননি। উল্টো তাদের যেন দ্রুত সাজা হয় সেজন্য আইনজীবী নিয়োগ দেন। এমনকি ৬ মাসের মধ্যে সাজা নিশ্চিত করার শর্তও দেন আইনজীবীকে।

এই মামলায় গত সোমবার (১১ মার্চ) তাদের সাজা দিয়েছেন আদালত। এমন নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে।

সাধারণত কোনো মামলায় আসামিরা আইনজীবী নিয়োগ করেন জামিন পেতে, খালাস পেতে, জেল থেকে ছাড়া পেতে বা সাজা কমাতে। কিন্তু এ মামলায় আসামিরা কেন উল্টো পথে হেঁটে নিজেদের সাজা চাইলেন, তা নিয়ে আদালতপাড়ায় শুরু হয়েছে আলোচনা।

কী বলছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী

আসামিপক্ষের আইনজীবী জান্নাতুল ফেরদৌস মুক্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৫ লাখ পিস মাদক মামলায় ১১ জন আসামিকে আদালত ১৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। অনাদায়ে ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। এই মামলায় আসামি পক্ষে একমাত্র আইনজীবী ছিলাম আমি। এই মামলায় আইনজীবী নিয়োগ হওয়ার পেছনের গল্পটা একেবারেই ভিন্ন—

এক ছুটির দিনে এই মামলার এক আসামি আমাকে ফোন করে বলেন— ‘আমাদের ১১ জনের সাজা করিয়ে দিতে হবে।’ শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সব আসামি চায় খালাস হতে, এরা ১১ জন সাজা চাইছে কেন? বললাম— মামলার অন্য আইনজীবীরা কী বলেন তা দেখে আমি সিদ্ধান্ত নেব। এ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম।

যথারীতি মামলার ধার্য তারিখের দিন আসামিদের পরিবারের মানুষজন এসে আমাকে মামলাটি পরিচালনার অনুরোধ জানান। আমি কোর্টে গেলাম এবং আসামিদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম— এটি ১৫ লাখ পিস মাদকের মামলা। ইতোমধ্যে নিয়োগকৃত আইনজীবীরা দীর্ঘ ৩ বছর মামলার কোনো তদবির করেননি।

মামলার বিস্তারিত নথি পর্যালোচনা করে দেখলাম— দীর্ঘ সাড়ে ৫ বছর যাবৎ আসামিদের পক্ষে বেশ কয়েকজন আইনজীবী মামলাটি পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু কেন জানি না শুধু তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্য হওয়ার পর দীর্ঘ চার বছর আর মামলা আগায়নি। আসামিদের প্রতি ধার্য তারিখে কোর্টে আনা- নেওয়া করা হয়, কিন্তু সাক্ষী আসে না।

নথি দেখে আসামিদের সঙ্গে কথা বললাম। আসামিদের কথা শুনে বললাম— জামিনের চেষ্টা করেননি কেন?

তারা প্রায় সবাই একসঙ্গে বলে উঠল— এই মামলায় জামিন দেবে না হাইকোর্ট; সাজা হলে আপিলে জামিন পাব, নয়ত জামিন পাব না। এ কথা শুনে আমি তো অবাক! কারণ, তাদের উত্তর এমন হবে আমি আশা করিনি। ভাবলাম এরা তো হাজতে থাকতে থাকতে কোর্ট কোন মামলায় কখন জামিন দেয় এ বিষয়ে হাফেজ হয়ে গেছে। আমি সোজা বললাম— আমি তো জুনিয়র আইনজীবী। এত বড় মামলায় আমাকে নিয়োগ করতে চান কেন? এসময় আসামিদের একজন (লিডার) বলে উঠল— আপনার বিষয়ে খবর নিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস আপনি তাড়াতাড়ি সাজা (প্রসেডিং ক্লোজ) করাতে পারবেন।

আমি বললাম— সাজা করালে তো আমার বদনাম হবে, তাছাড়া এই মামলায় আপনাদের সবার সাজা হবে শতভাগ। আমার কথা শুনে সবাই চেঁচিয়ে বলে উঠল— আমরা তো সাজাই চাচ্ছি। আরো বলল— আমাদের সবার সাজা করাতে পারলে আপনার অনেক সুনাম হবে জেলে। বুঝলাম তারা মামলার ফলাফল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।

আমার উপর তাদের ভরসা দেখে মামলাটি রিসিভ করলাম। তাদের শর্ত ছিল— ৬ মাসের মধ্যে সাজা করিয়ে দিতে হবে। গত বছরের ১৫ নভেম্বর মামলা রিসিভ করে ১৮টি ধার্য তারিখে কোর্টকে মেনশন দিয়ে ১০ জন সাক্ষীকে জেরা করি এবং সর্বশেষ আজ ৫ মাস ২৫ দিনের মাথায় তাদের মামলাটির বিচার কাজ শেষ হয়।

আইনজীবী মুক্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমানে মামলার জটলা এত বেশি যে, আসামিরা বাধ্য হচ্ছেন— মামলার অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে। তারা শুধু সাজা করিয়ে দেওয়ার জন্য আইনজীবী নিয়োগ করছেন। এটা আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।

মামলায় কী ছিল?

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ২৩ জুন পতেঙ্গার কয়লার ডিপো পুলিশ ফাঁড়ি এলাকা থেকে একটি মাছ ধরার ট্রলারে অভিযান চালিয়ে ১৫ লাখ ইয়াবাসহ ১২ জনকে আটক করে র‍্যাব। জব্দ ইয়াবার আনুমানিক মূল্য ছিল প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। এ ঘটনায় পরদিন র‍্যাব-৭ এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. ময়নাল হক বাদী হয়ে পলাতক আরেকজনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে পতেঙ্গা থানায় মামলা করেন।

একই বছরের ৩১ অক্টোবর ১২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন পতেঙ্গা থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলাম।

সোমবার (১১ মার্চ) চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক মোহাম্মদ কামাল হোসেন শিকদার এ রায় দেন। ১১ জনকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- মো. হাসেম, মো. ছাদেক, খায়রুল আমিন, মো. জাফর, মো. খোকন, মো. ইসমাইল, আনিসুর রহমান, আব্দুল খালেক, সাদ্দাম হোসেন, নুর আলম ও মো. সেলিম ওরফে মলয়। 

আপিলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি : আসামির পরিবার

মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি মো. হাসেমের বোন তসলিমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ওই ঘটনার পর থেকে প্রায় পাঁচ বছর মামলাটির তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাই মামলার দ্রুত রায় হওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করছিলাম। বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয়েছে। এখন যেহেতু সাজা হয়ে গেছে, তাই আমরা আপিলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

বিচার চলাকালে দুই আসামির মৃত্যু

২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর কোতোয়ালি থানার আইস ফ্যাক্টরি রোড বরিশাল কলোনি এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মামলার আসামি মো. ফারুক ওরফে বাইট্টা ফারুক নিহত হন। এই মামলার চার্জশিটে ফারুককে নিহত দেখালেও বন্দুকযুদ্ধের কথা উল্লেখ করেনি পুলিশ।

এছাড়া ২০২১ সালের ৮ জুন চার্জশিটভুক্ত এক নম্বর আসামি নজির আহমদ হাজতে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে মেডিকেল থেকে ১৪ জুন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ১৫ জুন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পুনরায় চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। পরে ১৬ জুন তার মৃত্যু হয়।

মামলার ১৩ আসামির মধ্যে এই দুজন ছাড়া বাকি ১১ জনের সাজা হয়েছে।

মামলার রায় প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ প্রথম আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্দুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯ (১) এর ৯ (খ) ধারায় করা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১১ আসামির প্রত্যেককে এই ধারার সর্বোচ্চ ১৫ বছর করে কারাদণ্ড, পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরো ছয় মাসের সাজা দিয়েছেন আদালত।’

এমআর/এমজে