জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজধানীর রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করাসহ দুজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে চতুর্থ দিনের সাক্ষ্য-জেরা শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১০ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ দিন ধার্য করেন। বাকি সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এদিন ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন দুজন সাক্ষী। তারা হলেন- বাড্ডা থানার এসআই মো. গোলাম কিবরিয়া খান ও তদন্ত সংস্থার সহকারী লাইব্রেরিয়ান কনস্টেবল আবু বকর সিদ্দিক। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাদের জেরা করেন পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন ও গ্রেপ্তার চঞ্চল চন্দ্র সরকারের আইনজীবী সারওয়ার জাহান। এখন পর্যন্ত এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন ছয়জন।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান। 

গতকাল সোমবার তৃতীয়-চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন শহীদ মো. নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নিহা ও প্রত্যক্ষদর্শী মো. ইয়াকুব। জবানবন্দিতে গত বছরের ১৯ জুলাই রামপুরার বনশ্রীতে পুলিশ-বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চালানো নৃশংস-নির্মমতার কথা ট্রাইব্যুনালের সামনে আনেন। একইসঙ্গে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার চান তারা।

গত ২৭ অক্টোবর দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন গুলিবিদ্ধ বাসিত খান মুসার বাবা মো. মোস্তাফিজুর রহমান। জবানবন্দিতে ১৯ জুলাই তার পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এক হৃদয়বিদারক বিবরণ তুলে ধরেন তিনি। নিজের চোখের সামনেই তার একমাত্র ছেলে মুসা গুলিবিদ্ধ হয়। একই বুলেটে শহীদ হন মা মায়া ইসলাম। বাচ্চা ছেলেটি বেঁচে থাকলেও কথা বলতে পারছে না। ফলে তছনছ হয়ে যায় তাদের পরিবারের সব স্বপ্ন। ২৩ অক্টোবর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন কার্নিশে ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ হওয়া আমির হোসেন।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই দিন এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সারওয়ার জাহান। আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনান তিনি। এরপর নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন চঞ্চল।

এ মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার। অন্য আসামিরা হলেন- খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান ও রামপুরা থানার সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। গত ১০ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

গত ১ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২৫ আগস্ট পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ৭ আগস্ট প্রসিকিউশনের পক্ষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ। গত ৩১ জুলাই চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। 

জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে রামপুরায় হোটেলে কাজ শেষে ঢাকায় থাকা ফুফুর বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বনশ্রী-মেরাদিয়া সড়কের দুই পাশে পুলিশ-বিজিবির গাড়ি দেখে ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে পাশে থাকা একটি নির্মাণাধীন চারতলা ভবনের ছাদে ওঠেন তিনি। 

ওই সময় পুলিশও তার পিছু পিছু যায়। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ওই নির্মাণাধীন ভবনটির ছাদের কার্নিশের রড ধরে ঝুলে থাকেন আমির। কিন্তু তাকে দেখে ফেলে পুলিশ। পরে তার ওপর ছয়টি গুলি ছোড়েন এক পুলিশ সদস্য। এতে তিন তলায় পড়ে গেলে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন উদ্ধার করেন। এরপর বনশ্রীর একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওইদিন রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন ভুক্তভোগী এই তরুণ।

এছাড়া, একই দিন রামপুরার বনশ্রী এলাকায় পুলিশের গুলিতে নাদিম ও মায়া ইসলাম নিহত হন। একইসঙ্গে মায়া ইসলামের ছয় বছর বয়সী নাতি বাসিত খান মুসা গুলিবিদ্ধ হয়। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিলে এখনও কথা বলতে পারছে না এই শিশু।

গত ২৬ জানুয়ারি রাতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে সাবেক এএসআই চঞ্চল সরকারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল। এর নেতৃত্ব দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা।

এমআরআর/এমজে