‘দুই হাত প্রসারিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আবু সাঈদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সামান্য পিছু গেলে আবারও গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নিলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষ্যে এমনটিই উল্লেখ করেছেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী ইমরান আহমেদ।

মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন– অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদসহ ৩০ আসামির বিরুদ্ধে ১৩ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন ইমরান। ২৭ বছর বয়সী এই তরুণ কারমাইকেল কলেজের ইতিহাস বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদেরও একজন ছিলেন। তখন অনার্সে পড়তেন। মাস্টার্সে থাকতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে রংপুরে কর্মসূচি পালন করেছিলেন তিনি।

ইমরান বলেন, গত বছরের ১৬ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে রংপুর নগরীর চারতলা মোড় এলাকা থেকে আমরা একটি মিছিল নিয়ে মডার্ন মোড় অভিমুখে যাত্রা শুরু করি। নগরীর লালবাগ এলাকায় পৌঁছালে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে আমাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু সংখ্যায় বেশি থাকায় পিছু হটেন তারা। আমরা আবারও স্লোগান দিতে দিতে রওনা হই। দুপুর ১টার দিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট পার হয়ে এক নম্বর গেটের কাছাকাছি পৌঁছাই। ঘণ্টাখানেক পর আমাদের বাধা দেয় পুলিশ। কিন্তু আমরা স্লোগান দিতে থাকি। একপর্যায়ে কোনো রকম সতর্ক বার্তা ছাড়াই সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে পুলিশ। এ ছাড়া অতর্কিত হামলা চালানো হয়। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি করেন। অনেকে গুরুতর আহত হন।

তিনি বলেন, বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাঈদও মাথার পেছনে মারাত্মক আঘাত পান। ফলে রক্ত পড়া শুরু হয়। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের ভেতরে অবস্থান নেয় পুলিশ। সেখানে ছাত্রলীগের পোমেল বড়ুয়া, মাহফুজ, আরিফ, বাবুল, টগর, ফজলে রাব্বী, আক্তার, আকাশ, মাসুদ রানা, সেজান মাহমুদসহ রংপুর মহানগর, জেলা-উপজেলা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আগে থেকেই ছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কোনো ভূমিকা রাখেনি বা অবৈধভাবে বহিরাগত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। উল্টো ছাত্রলীগ-পুলিশের সঙ্গে কিছুক্ষণ থেকে চলে যান প্রক্টর।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন– মশিউর রহমান, আসাদ মণ্ডল, কর্মকর্তা রাফিউল হাসান রাসেল, মনিরুজ্জামান পলাশ, হাফিজুর রহমান তুফান, কর্মচারী নুরুন্নবী, নূর আলম, মাহবুবুর রহমান, আমির হাসান আমু ও আনোয়ার পারভেজ আপেল। দুপুর ২টার পর আমাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি অংশ গেট খোলার চেষ্টা করে। তবে ভেতরে থাকা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, পুলিশ কর্মকর্তা এসি আরিফ, এসি ইমরান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতী ভূষণ রায়, তাজহাট থানার ওসি রবিউলসহ সবাই মিলে ছাত্রদের দিকে ঢিল ছোড়েন। একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তারা গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসতে থাকেন। তখন গেটের সামনে অবস্থান নেওয়া ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।

এই সাক্ষী বলেন, ঠিক তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান আবু সাঈদ। ওই সময় খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে পুলিশ। প্রথম গুলি খাওয়ার পর সামন্য একটু পিছিয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু আবারও গুলিবিদ্ধ হন। তখন সড়কের বিভাজক (ডিভাইডার) পার হয়ে একটু পেছনে আসেন। আরেকটু পেছনে থাকা আয়ান এগিয়ে এসে আবু সাঈদকে ধরেন। এরপর একটু সরে যাওয়ার পর সাজু রায়সহ আরও কয়েকজন মিলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এক ঘণ্টা পর তার মৃত্যুর খবর পাই আমরা। পরবর্তীতে জানতে পারি তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান, ডিসি (ক্রাইম) আবু মারুফ, এডিসি (ডিবি) শাহ নুর আলম পাটোয়ারী, এসি আরিফ, তাজহাট থানার ওসি রবিউলের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মশিউর রহমান, আসাদ মণ্ডল, কর্মকর্তা রাফিউল হাসান রাসেল, হাফিজুর রহমান তুফান, মনিরুজ্জামান পলাশের সহযোগিতায় এএসআই আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্রের গুলিতে আবু সাঈদ মারা গেছেন। যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোহিতায় তার মৃত্যু হয়েছে; সহযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি তাদের প্রত্যেকের শাস্তি দাবি করছি।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ইমরানকে জেরা করেন পলাতক ২৪ জনের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত চার আইনজীবী ও উপস্থিত ছয় আসামির আইনজীবীরা। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।

এমআরআর/বিআরইউ