সরকারি আবাসন, জমি বরাদ্দ সংক্রান্ত অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক অসদাচরণের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে বিশেষ সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে সরকারি প্লট বরাদ্দ নেওয়ার ৩ মামলায় আজ (বৃহস্পতিবার) রায় ঘোষণা করেন ঢাকার বিশেষ জজ-৫ এর বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন। আদালতের দেওয়া রায়ে দুই প্রতিষ্ঠানই আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বার্থে বরাদ্দ প্রদান করেছে, যা সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালাকে অবমাননা করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রায়ে ৩ মামলায় শেখ হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া এক মামলায় তার ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদকে (জয়) পাঁচ বছর, আরেক মামলায় মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরও ১৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এদিকে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকারকে খালাস দিয়েছেন আদালত।

আসামিদের সাজা দেওয়ার পাশাপাশি সরকারি আবাসন ও জমি বরাদ্দ সংক্রান্ত অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক অসদাচরণের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক এবং গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়কে উদ্দেশ্য করে একাধিক সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দেন আদালত। 

রাজউক সম্পর্কে আদালতের পর্যবেক্ষণ

রায়ে বলা হয়, রাজউক দীর্ঘদিন ধরে ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারি জমি বরাদ্দের আইনি প্রক্রিয়া উপেক্ষা করেছে। চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাধ্যতামূলক নিয়ম না মেনে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আবেদনের অনুমোদন দিয়েছেন। বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মন্ত্রী-এমপি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, আমলা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই বরাবর সুবিধা পেয়েছেন। বহুক্ষেত্রে নথিপত্র যাচাই না করে বা প্রয়োজনীয় যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সাংবিধানিক দায়িত্বের লঙ্ঘন।

রাজউকের জন্য আদালতের নির্দেশনা

১. সব অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব থেকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলা করতে হবে।

২. ওই সময়ে দেওয়া সব বরাদ্দের ওপর স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ফরেনসিক অডিট করতে হবে।

৩. বরাদ্দের জন্য ডিজিটাল লটারি চালু করতে হবে; লাইভ সম্প্রচার, অডিট ট্রেইল ও এনক্রিপ্টেড সিস্টেম বাধ্যতামূলক।

৪. বেআইনি বরাদ্দ অনুমোদন করা কর্মকর্তারা যৌথভাবে দায়ী হবেন এবং চাকরি থেকে বরখাস্তসহ তাদের ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি করতে হবে।

৫. দুর্নীতি প্রকাশকারী হুইসেল-ব্লোয়ারদের আইনি সুরক্ষা ও পুরস্কার দিতে হবে।

৬. গৃহহীন, নিম্ন আয়ের শ্রমিক ও অনিরাপদ পরিবেশে বসবাসকারী পরিবারকে অগ্রাধিকার দিয়ে পয়েন্ট-ভিত্তিক যোগ্যতা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

৭. একক মা, প্রতিবন্ধী, নিম্ন আয়ের পরিবার ও সরকারি চাকরি শেষে আবাসনহীনদের জন্য নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ রাখতে হবে।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ

রায়ে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়টি রাজউককে সঠিকভাবে তদারকি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের তদারকি ছিল নামমাত্র। বরং মন্ত্রণালয় নিজে “বিশেষ শ্রেণি” বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় বেআইনি প্রভাব খাটিয়েছে। এতে নিয়ম ভঙ্গের পরিবেশ আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের জন্য আদালতের নির্দেশনা

১. সরকারের বিশেষ সুপারিশ নীতিমালা বাতিল করতে হবে।
২.বিশেষ শ্রেণির বরাদ্দ সংক্রান্ত কোনো সুপারিশ চলমান থাকলে তা বাতিল এবং নতুন করে এই শ্রেণিতে কোনো বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।
৩. মন্ত্রণালয়কে রাজউকের ওপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৪. স্বাধীন নজরদারি ইউনিট গঠন করতে হবে। 
৫. অনিয়মে জড়িত মন্ত্রণালয়সহ রাজউকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. জাতীয় সম্পত্তি ডাটাবেস, ভূমি রেকর্ড, সিটি করপোরেশন হোল্ডিং, সাব-রেজিস্ট্রি ও টিআইএন নম্বরের সঙ্গে রাজউকের ডিজিটাল সংযোগ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৭. আবেদনকারীর তালিকা, যোগ্যতার ভিত্তি, প্লট নম্বর ও সুবিধাভোগীর তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করতে হবে।
৮. ডিজিটাল লটারি, পয়েন্ট-ভিত্তিক স্কোরিং ও কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কাঠামোগত সংস্কার বাধ্যতামূলক।
৯. দুর্নীতি উন্মোচনকারী কর্মীদের জন্য আইনি সুরক্ষা ও পুরস্কার নিশ্চিত করতে হবে।

বরাদ্দ পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিতরণ

আদালতের দেওয়া রায়ে অতীতের সব বরাদ্দ পর্যালোচনা করে বেআইনি বা একাধিক প্লট ভোগকারীদের শনাক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া পুনরুদ্ধার হওয়া সব প্লট শুধু ভূমিহীন নাগরিক ও যোগ্য আবেদনকারীদের পুনরায় বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

এনআর/এসএম