জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘিরে কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

সোমবার (৮ ডিসেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এ জবানবন্দি দেন সাক্ষী। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে এই প্রথম কোনো সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে ক্যামেরা ট্রায়ালে।

এদিন বেলা ১১টার পর ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয়। আসামিরাও কাঠগড়ায় ছিলেন। একপর্যায়ে সাক্ষীর নিরাপত্তার স্বার্থে ক্যামেরা ট্রায়ালে জবানবন্দি নেওয়ার আবেদন করেন প্রসিকিউশন। পরে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে এ মামলার প্রথম সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়। তার নাম-পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়নি। ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেওয়ায় সাক্ষীরা আসামিদের হুমকি-ধমকি পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে ক্যামেরা ট্রায়ালে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন সূত্র।

এর আগে, ২৫ নভেম্বর হানিফের মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন শেষে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। সূচনা বক্তব্যে মামলার বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার পাশাপাশি সাক্ষীর তালিকা, অডিও-ভিডিও, পত্রপত্রিকার তথ্যপ্রমাণের বিবরণ দেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। একই সঙ্গে এ অপরাধের দায়মুক্তির সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ করার কারণে যেন বিচার না হয়; এমন আর্জি জানান চার আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।

হানিফ ছাড়া বাকি তিন আসামি হলেন- কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সদর উদ্দিন খান, জেলা সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা।

এ মামলায় মোট সাক্ষী ৩৮ জন। এর মধ্যে শহীদ পরিবারের ৮, প্রত্যক্ষদর্শী ৮, আহত ৮, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ৬, পুলিশ ১, সাংবাদিক ১, জব্দতালিকা ২, বিশেষজ্ঞ ২, বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ১ ও মূল তদন্ত কর্মকর্তা একজন রয়েছেন। 

গত ২ নভেম্বর হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। একইসঙ্গে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনসহ সাক্ষ্যের জন্য আজকের দিন ঠিক করা হয়। বিচার শুরুর আদেশের দিন চারজনের বিরুদ্ধে আনা তিনটি অভিযোগ পড়া হয়। ২৮ অক্টোবর হানিফসহ পলাতক চার আসামির পক্ষে অভিযোগ পড়েন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। শুরুতে তিনি ফরমাল চার্জে প্রসিকিউশনের আনা পটভূমি নিয়ে সমালোচনা করেন।

এরপর সুনির্দিষ্ট তিনটি অভিযোগ পড়ে আসামিদের অব্যাহতির আবেদন করেন। এর আগের দিন তথা ২৭ অক্টোবর এ নিয়ে শুনানি শেষ করে প্রসিকিউশন। ২৩ অক্টোবর হানিফসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার কথা ছিল। তবে পলাতক থাকায় আইনানুযায়ী তাদের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল-২।

১৪ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে এই চারজনকে হাজির হওয়ার নির্দেশ ছিল। না আসায় তাদের গ্রেপ্তারে জাতীয় দৈনিক দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দেওয়া হয়। ৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ৫ অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেন প্রসিকিউশন। এতে সুনির্দিষ্ট তিনটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে উসকানিমূলক বক্তব্য, ষড়যন্ত্র ও কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যা।

উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়। তাদের গুলিতে শহীদ হন শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম, সুরুজ আলী বাবু, শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মুস্তাকিন, উসামা, ব্যবসায়ী বাবলু ফরাজী ও চাকরিজীবী ইউসুফ শেখ। আহত হন বহু নিরীহ মানুষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই চারজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। পরে তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন।

অপরদিকে, হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে চতুর্থ দিনের মতো সাক্ষ্য দিয়েছেন ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের উপপরিদর্শক শাহেদ জোবায়ের লরেন্স। চতুর্থ নম্বর সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন একই ট্রাইব্যুনাল। পরে তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৫ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়। 

এমআরআর/এমজে