উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের জন্য সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়ন করা বাস্তবতার নিরিখে অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

বুধবার (১৫ ডিসেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে বিদায়ী বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি এ মন্তব্য করেন।

বক্তব্যের শুরুতে সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘পরম করুণাময় আল্লাহর নিকট গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি, যিনি আমার মতো একজন সাধারণ মানুষকে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন করেছেন। আজকের এ দিনটিও আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুজিববর্ষ এবং মহান স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল সুবর্ণজয়ন্তীর এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। গভীরভাবে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। আরও স্মরণ করছি ৩০ লক্ষ শহীদ এবং ২ লক্ষ মা-বোনকে, যাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্মরণ করছি কারা অন্তরালে নিহত চার নেতাকে। স্মরণ করছি ১৫ আগস্টে ঘাতকদের গুলিতে নিহত বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের।

আমি আরও স্মরণ করছি আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা আইনজীবী মরহুম সৈয়দ মোস্তফা আলী, কুমিল্লা বারের সাবেক সভাপতি যার কাছে আমার আইন পেশার হাতেখড়ি। আমি স্মরণ করছি আমার অশীতিপর স্নেহময়ী মা বেগম কাওছার জাহান যিনি আমাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি আমার সহধর্মিণী বেগম সামিনা খালেকের প্রতি, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.বি (অনার্স) এবং এলএল.এম ডিগ্রি অর্জনের পর আইন পেশায় যোগদান করেন। আমি বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তিনি আমার বিচারকার্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকল্পে স্বেচ্ছায় আইন পেশা ত্যাগ করেন।

আমি আরও স্মরণ করছি আমার শ্রদ্ধেয় সিনিয়র আইনজীবী মরহুম শিহাব উল্লাহ এবং প্রথিতযশা আইনজীবী মরহুম খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমাদকে। তাদের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায় সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় আমি নিবিষ্ট হই। এ মুহূর্তে হৃদয়ের গহীন থেকে স্মরণ করছি এ বারের প্রথিতযশা সিনিয়র আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মরহুম মাহমুদুল ইসলামকে, যার সান্নিধ্যে আমি ডেপুটি অ্যাটর্নি-জেনারেল হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তার সান্নিধ্য আমার বিচারক জীবনের জন্য পাথেয় হয়েছে। তার এ ঋণ কখনো শোধ হবে না। আমি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সাবেক প্রধান বিচারপতি এ.টি.এম. আফজালকে, যার আদালতে হাইকোর্ট বিভাগে আমি আইনজীবী হিসেবে প্রথম অ্যাপিয়ার করেছিলাম। এ ক্ষণে আরও স্মরণ করছি কোভিড-১৯ এ যেসব আইনজীবী এবং বিচারকদের আমরা হারিয়েছি।’

বিচারক ও আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ; আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে বিধৃত রয়েছে। তিনটি অঙ্গের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই গণতন্ত্রকে বিকশিত করে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এটা আমাদের সংবিধানের সৌন্দর্য। একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস হলো জনগণের আস্থা। এটা হলো বিচারকদের সততা, সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতার প্রতি গণমানুষের অবিচল বিশ্বাস। সাধারণ মানুষের এই আস্থা অর্জনের জন্য বিচারকদের একদিকে যেমন উঁচু নৈতিক মূল্যবোধ ও চরিত্রের অধিকারী হতে হবে, তেমনি অন্যদিকে সদা বিকাশমান ও পরিবর্তনশীল আইন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও সামাজিক মূল্যবোধ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এটা অর্জন সম্ভব কেবলমাত্র নিয়মিত অধ্যয়ন, সময়মতো এবং আইনানুগভাবে বিচারিক কাজ সম্পন্নকরণের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি আর এম (রাজেন্দ্র মাল) লোধার কথার প্রতিধ্বনি করে বলছি, একজন আইনজীবীর জীবন কখনই মসৃণ নয়। বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে প্রয়োজন একাগ্র নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, ধৈর্য, সততা, পরিশ্রম এবং নিরন্তর অধ্যয়ন। প্রতিটি মামলা পরিচালনায় তার শিক্ষা, মেধা এবং বিচক্ষণতার প্রয়োগ হতে হবে। জেনে-শুনে মামলার ঘটনার বিকৃত উপস্থাপনা করা একজন আইনজীবীর কখনই উচিত নয়। সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং আইনি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আদালতকে সহায়তা করা মূল উদ্দেশ্য। আইন পেশার সুমহান মর্যাদা রক্ষা করতে সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে বার ও বেঞ্চকে সোচ্চার থাকতে হবে। আইনজীবী ও বিচারকরা হচ্ছে একটি পাখির দুটি পাখার মতো। বাম হাত ও ডান হাতের মতো। তাদের পরস্পরের প্রতি আস্থার সম্পর্ক বিচার ব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।’

মামলাজট কমাতে দ্বিগুণ বিচারক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘দেশে বিদ্যমান মামলার পরিসংখ্যান থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, বিচারের অভিগম্যতা অনেক বেড়েছে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, এখনও বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ জনগণের প্রবল আস্থা রয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করে বিচার বিভাগ তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার চূড়ান্ত অভিভাবক। বিচারের সমতার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জনে নিরন্তর কাজ করতে হবে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, মামলার সংখ্যা বিবেচনায় আমাদের বিচারকের সংখ্যা অপ্রতুল। মামলা জট নিরসনে দেশের অধস্তন আদালত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচারকের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। জেনে খুশি হয়েছি যে, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ শুরু করেছে। সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা বাস্তবতার নিরিখে অপরিহার্য। এতে বিচারপতি নিয়োগের কাজটি আরও স্বচ্ছ ও দ্রুত হবে এবং জনগণের মধ্যে বিচারপতি নিয়োগের স্বচ্ছতা সম্পর্কে ভিত্তিহীন ধারণা দূরীভূত হবে।

দেশের আদালতগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বারোপ করে ২২তম প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকার নিরন্তর কাজ করলেও অনেক জেলায় এখনো জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি বিল্ডিং নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়নি। ফলে একই এজলাসে একাধিক বিচারককে কাজ করতে হয়। এতে সময়ের অপচয় হয়। সংগত কারণে বিচারকদের কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা বাঞ্ছনীয়। ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য ফিজিক্যাল কোর্টের মতো তেমন অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে ফিজিক্যাল এবং ভার্চুয়াল কোর্ট যুগোপতভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করলে বিচার নিষ্পত্তি আরও দ্রুততর হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’

নিজের অবসর জীবনের জন্য দোয়া কামনা করে সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আমি আপনাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। আপনাদের এই হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার জন্য আমি সবাইকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। আইনজীবী এবং বিচারক হিসেবে আমি যদি কোনো কারণে আপনাদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি, তাহলে আমাকে নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপনাদের সম্মুখে এ আসন থেকে আমার প্রস্থান হবে, আগামী দুই সপ্তাহ অন্তে আমার বিচারক জীবনের ইতি ঘটবে এবং জীবনের শেষ অধ্যায় শুরু হবে। আমার অবসর জীবন যেন শান্তিময় হয় এ জন্য আপনাদের দোয়া কামনা করছি। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের সহকর্মী বিচারপতিগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভালোবাসা পেয়েছি। তাই এই বিদায় বেলায় তাদের প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে আইনজীবীদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। 

বিচারকদের কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিপুল সংখ্যক মামলার জট আমাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। মামলা জট হ্রাস ও মানুষের আস্থা ধরে রাখতে হলে বিচারকদের আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। বিচার প্রার্থীদের প্রতি গভীর মমত্ববোধসহ বিচারকার্য পরিচালনার নিমিত্তে সকল স্তরের বিচারকদের অনুরোধ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।’

এমএইচডি/এসকেডি