বদলি মামলার খোঁজে আদালতের সংশ্লিষ্ট সেকশনে আইনজীবীদের ভিড় | ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকার নিম্ন আদালতে বদলি মামলা খুঁজে পেতে বেশ হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে আইনজীবীদের। অনেক ক্ষেত্রে বদলি মামলার গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক কার্যক্রম শেষ হলেও সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানতেই পারেন না, তার মামলার সর্বশেষ কী অবস্থা! ফলে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। সবচেয়ে বড় বিষয়, বদলি মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করতে পাঁচ থেকে ছয় মাসের অধিক সময় লেগে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা। বিচার কাজে দেখা দেয় দীর্ঘসূত্রতা।  

আদালত সূত্রে জানা যায়, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাথমিক স্টেজে একটি মামলার বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারলেও বেশির ভাগ মামলার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। আইন অনুযায়ী, অধিকাংশ মামলাই বিচারের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে দায়রা জজ আদালতের সংশ্লিষ্ট সেকশনে (শাখায়) বদলি হয়ে আসে। প্রতি সপ্তাহে এমন মামলার সংখ্যা ৬০০ থেকে ৭০০টি। সেকশনে আসার পর সেগুলো রিসিভ, স্বাক্ষর, আদালত নির্ধারণ করে ওই আদালতে পাঠানোসহ যাবতীয় কাজ সনাতন পদ্ধতিতে (ম্যানুয়ালি) সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ একটি নিবন্ধন (রেজিস্টার) খাতায় লিখিতভাবে সংরক্ষণ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এছাড়া পর্যাপ্ত জনবল ও স্থান সংকুলান না হওয়ায় ওই শাখা থেকে সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচারের জন্য পাঠাতে সময় লাগে পাঁচ-ছয় মাসের অধিক সময়।

মহানগর দায়রা জজ আদালতের মামলা বদলির নিবন্ধন শাখা | ছবি- ঢাকা পোস্ট
প্রতি সপ্তাহে ৬০০ থেকে ৭০০ মামলার বদলি সংক্রান্ত নথি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজ আদালতের সেকশনে আসে। এগুলো রিসিভ, স্বাক্ষর, আদালত নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠানোসহ যাবতীয় কাজ ম্যানুয়ালি রেজিস্টার মেইনটেইন করতে হয়। এছাড়া পর্যাপ্ত জনবল ও স্থানের সংকুলান না হওয়ায় সময়টা বেশি লাগে। আমরাও চাই দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হোক

শাহ মো. মামুন, নাজির, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত

মামলাটি কোন বিচারিক আদালতে গেল সেটা খুঁজে পেতেও আইনজীবীদের নানা হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। বদলির ওই মামলা খুঁজতে বেশ কয়েকবার সংশ্লিষ্ট শাখায় ধর্ণা দিতে হয়। দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর নিবন্ধন খাতায় এক এক করে খুঁজে দেখতে হয় কোন মামলা কোথায় বদলি হলো। ভুক্তভোগী আইনজীবীরা জানান, যেদিন থেকে মামলার বদলি, তার কয়েক মাস পর থেকে শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। এভাবে চলতে থাকে চার/পাঁচ মাস। বিচারপ্রার্থীরা এ সময় মামলার অগ্রগতি জানতে ফোন দেন। কিন্তু কিছু জানাতে না পারায় তারাও ভুল বোঝেন। তাদের সঙ্গে শুরু হয় টানাপোড়েন। বিচারকার্যক্রমেও দেখা দেয় দীর্ঘসূত্রতা।

কোন আদালতে হবে বিচার, তা খুঁজে দেখছেন আইনজীবীরা | ছবি- ঢাকা পোস্ট

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (নাজির) শাহ মো. মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে ৬০০ থেকে ৭০০ মামলার বদলি সংক্রান্ত নথি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজ আদালতের সেকশনে আসে। এগুলো রিসিভ, স্বাক্ষর, আদালত নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠানোসহ যাবতীয় কাজ ম্যানুয়ালি রেজিস্টার মেইনটেইন করতে হয়। এছাড়া পর্যাপ্ত জনবল ও স্থানের সংকুলান না হওয়ায় সময়টা বেশি লাগে। আমরাও চাই দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হোক।

কীভাবে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি ডিজিটাল পদ্ধতি আনা যায় তাহলে এ সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভব। আমরা যত দূর সম্ভব দ্রুত কাজ করার চেষ্টা করছি। তারপরও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। এতে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা উপকৃত হবেন।’

আমি মনে করি, মামলা বদলির প্রক্রিয়াটি যদি ডিজিটালাইজড করা যায় তাহলে এমন বিড়ম্বনা অনেকাংশে কমে যাবে। আইনজীবীরা উপকৃত হবেন। বিচারপ্রার্থীরাও সঠিক সময়ে ন্যায় বিচার পাবেন

ইকবাল হোসেন, সভাপতি, ঢাকা আইনজীবী সমিতি 

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইকবাল হোসেন এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে যে মামলাগুলো মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য বদলি হয়ে যাচ্ছে সে মামলাগুলো খুঁজে পেতে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের নানা হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। মামলাগুলো এখনও এনালগ পদ্ধতিতে খাতায় নথিভুক্ত করতে হয়। এতে সময় বেশি লাগে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মামলাগুলো বদলি হয়ে বিচারিক আদালতে অর্ডার হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী তা খুঁজে পেয়ে দেখেন, মামলার গুরুত্বপূর্ণ স্টেজ পার হয়ে গেছে। এতে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হন।’ 

মামলা বদলির প্রক্রিয়াটি ডিজিটালাইজড হলে ভোগান্তি কমত, বলছেন আইনজীবীরা | ছবি- ঢাকা পোস্ট

‘আমি মনে করি, মামলা বদলির প্রক্রিয়াটি যদি ডিজিটালাইজড করা যায় তাহলে এমন বিড়ম্বনা অনেকাংশে কমে যাবে। আইনজীবীরা উপকৃত হবেন। বিচারপ্রার্থীরাও সঠিক সময়ে ন্যায় বিচার পাবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি সুরাহার জন্য আমি আমার বর্তমান কমিটিকে নিয়ে মহানগর দায়রা জজ মহোদয়ের সঙ্গে বসেছি। লিখিত ও মৌখিকভাবে বিষয়টি সুরাহের জন্য বলা হলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।’

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সংশ্লিষ্ট সেকশনে বদলি মামলা খুঁজতে আসেন আইনজীবী খালিদ হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চার মাসে আগে ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে আমার এনআই অ্যাক্টের একটি মামলা মহানগরে বদলির আদেশ হয়। এখনও তা বদলির লিস্টে উঠে নাই। মামলাটি খোঁজার জন্য প্রতি সপ্তাহে ১/২ বার আসতে হয়। দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তা খুঁজতে হয়, সহজে পাওয়া যায় না।’

আদালত বদলি ও বিচার কার্যক্রম শুরু করতে লাগে ৫-৬ মাস, ফলে দেখা যায় দীর্ঘসূত্রতা | ছবি- ঢাকা পোস্ট  

তিনি আরও বলেন, ‘উচ্চ আদালতে প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হলেও নিম্ন আদালতে এর ব্যবহার এখনও পুরোপুরি লক্ষ্য করা যায়নি। কিছু কিছু আদালতের বিচারকগণ সাক্ষীর জবানবন্দি, আদেশ ও রায়ের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার নিচ্ছেন। এক্ষেত্রেও যদি প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হয় তাহলে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমে আসবে।’

মহানগর দায়রা জজ আদালতের বদলি সেকশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মামলার তুলনায় আদালতের স্টাফ অনেক কম। অনেক মামলা বদলি হওয়ায় তা খাতায় ওঠাতে একটু সময় লাগছে। এটা যদি ডিজিটালাইজড করা যেত তাহলে আইনজীবী ও আমাদের কষ্ট অনেক কম হতো।’

টিএইচ/এমএআর/