বিচার প্রশাসনের দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। রোববার আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে প্রধান বিচারপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানানো হয়।

আইনজীবী সমিতির পক্ষে লিখিত বক্তব্যে পাঠ করেন সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে একজন বিচারপ্রার্থীর সর্বশেষ আশা ভরসার স্থল। সুতরাং এই অঙ্গনকে কুলষমুক্ত রাখা, দুর্নীতি মুক্ত রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা সদা-সর্বদা সোচ্চার। তবে সমিতির সদস্য হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকি। আপনার কার্যকালের এই প্রথম কর্ম দিবসে তার কয়েকটি বিষয় আমি সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করতে চাই।’

‘বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি মোশন বেঞ্চগুলো থেকে স্বল্প মেয়াদে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাথমিকভাবে ছয় মাস বা এক বছর। জামিন প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে আদেশ নামানো, আদেশ ডেসপাস করা প্রতিটি ক্ষেত্রেই অহেতুক নানাবিধ অতিরিক্ত পয়সা খরচ করতে হয়। অথচ আদালতে ফাইল আনা, ফাইল পাঠানো কিংবা আদেশ পাঠানো আইনগতভাবে অত্র আদালতের প্রশাসনিক দায়িত্ব। নবীন আইনজীবীরা এটিই যে নিয়ম সেটিই আজ ভুলতে বসেছে।’ 

‘অনিয়ম এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মনে হয় এসব প্রশাসনিক কাজ সংশ্লিষ্ট আইনজীবী বা আইনজীবী সহকারীর দায়িত্ব। এ কারণে বিচার প্রশাসনে নানারকম দুর্নীতি ও অনিয়ম ঘটছে। একটি মামলা এফিডেভিট করে দায়েরের পর আদালত পর্যন্ত পৌঁছাতে ও আদালতের আদেশের পর আদেশ পাঠানো পর্যন্ত পদে পদে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়। কোনো মামলা জামিন কিংবা স্থগিতাদেশ বৃদ্ধির জন্য সময়মত নির্দিষ্ট আদালতে ফাইল না আসা কিংবা আদেশ সময়মত নিম্ন আদালতে না পৌঁছানোর ফলে জামিন প্রাপ্ত ব্যক্তির অহরহ নিম্ন আদালত কর্তৃক পুনরায় কারাগারে প্রেরণের ঘটনা ঘটছে। এসব সমস্যা সমাধানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করার জন্য আপনার প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।’

সুপ্রিম কোর্ট বার সম্পাদক বলেন, ‘এ কথা অনস্বীকার্য যে, হাইকোর্ট প্রদত্ত অন্তর্বর্তীকালীন যেকোনো আদেশ, বিশেষ করে জামিন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে মামলার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চেম্বার জজ আদালতে একতরফা শুনানি হয়ে থাকে। যেহেতু প্রতিটি আবেদনপত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর মোবাইল নম্বর থাকে, আপিল শুনানির পূর্বে আপিলকারী পক্ষ কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগে মামলা দায়েরকারী বিজ্ঞ আইনজীবীকে অবহিত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ আইনজীবীকে অবহিত করণের বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান করা হবে।’

আপিল বিভাগ ও সিনিয়র আইনজীবী তালিকাভুক্তির জন্য নীতিমালা করার বিষয়ে রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তি, অ্যাডভোকেট-অন রেকর্ড হিসেবে তালিকাভুক্তি ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে সম্মাননা প্রদানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড ও নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। কোন একজন ল’ গ্রাজুয়েট নিম্ন আদালতে আইনজীবী হওয়ার জন্য বার কাউন্সিল নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রথমে এমসিকিউ, পরবর্তীতে লিখিত ও সর্বশেষ ভাইভা দিয়ে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। হাইকোর্ট বিভাগে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে এমসিকিউ, লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়।’ 

‘একটি তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে হয়। অথচ আপিল বিভাগে তালিকাভুক্তির জন্য সুনির্দিষ্ট কোন নিয়ম বা মানদণ্ড না থাকায় অধিকাংশ আইনজীবী তালিকাভুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না। ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বেশ কজন বিজ্ঞ আইনজীবীর নাম উল্লেখ করা আছে যারা অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে এ সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার পর এর স্বচ্ছতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পান। আমরা মনে করি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে আপিল বিভাগে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্তি, অ্যাডভোকেট-অন রেকর্ড তালিকাভুক্তি ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে সম্মাননার বিষয়টি নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন।’

প্রধান বিচারপতির কাছে সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘আপনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সততা ও দক্ষতার সঙ্গে আপনার দায়িত্ব পালন করবেন। যেহেতু আপনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন, সুতরাং এই সমিতির সদস্যদের জন্য আপনি আমাদের অভিভাবক হিসেবে সমিতির কল্যাণে কাজ করবেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এ বিপুল সংখ্যক আইনজীবীর পেশা পরিচালনার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল। বিশেষ করে বিজ্ঞ সদস্যদের পেশা পরিচালনা করার জন্য অত্র সমিতির বর্তমান ৪টি ভবনে আসন সংকুলান একেবারেই হয় না। এজন্য আমরা সিনিয়র অ্যাডভোকেট ও অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটি, ২০২০-২১ সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতির সম্মতিক্রমেই ‘ভবন-২০২০’ নামে একটি ভবনের কাজ শুরু করেছিলাম। যেটির প্রক্রিয়াগত সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে ৫০ কোটি টাকায় উক্ত ভবন নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু কাজ শুরুর পরেই সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি পত্র দিয়ে ভবনের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আপনি নিশ্চয়ই বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত আছেন। আমাদের প্রত্যাশা, বিজ্ঞ আইনজীবীদের কল্যাণে অবিলম্বে উক্ত ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাধা অপসারণ করে সমিতির নির্মাণাধীন ভবনের কাজ সম্পন্ন করার অনুমতি প্রদান করা হবে।’

‘এছাড়া সমিতি প্রাঙ্গণে গড়ে উঠা সুপ্রিম কোর্টের স্টাফদের জন্য যে অস্থায়ী টিনসেড সেটিও সমিতি ভবনের মধ্যে বড্ড বেমানান। আপনাকে অনুরোধ জানাতে চাই, অবিলম্বে উক্ত জায়গা সমিতির অনুকূলে দিয়ে সমিতির সদস্যদের জন্য এখানে আরেকটি বহুতল ভবন নির্মাণ করে সদস্যদের পেশা পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে আপনি ভূমিকা রাখবেন। কোর্ট অঙ্গনে গাড়ি পার্কিং একটি বড় সমস্যা। পার্কিং সমস্যা সমাধানের জন্য ভূগর্ভস্থ বহুতল বিশিষ্ট পার্কিং এরিয়া করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আপনাকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। ’

সুপ্রিম কোর্টের ছুটি কমানোর আহ্বান জানিয়ে বার সম্পাদক বলেন, করোনার ভয়াবহতার কারণে বিগত প্রায় দুই বছর আমাদের আইন পেশা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা বিগত ২০২০ ও ২০২১ সালের পূর্ব নির্ধারিত ছুটি বাতিল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে ছুটি কমিয়ে আনার জন্য অত্র সমিতির পক্ষ থেকে  প্রধান বিচারপতিকে বারবার অনুরোধ জানিয়ে এসেছি। আমরা প্রত্যাশা করব, মামলাজট কমাতে, বিচারপ্রার্থী মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ এবং বিজ্ঞ আইনজীবীগণ যাতে তাদের পেশার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে আগামী বছরগুলোতে চিরাচরিত ছুটিগুলো কমিয়ে আনা হবে।’

ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘আপনি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করার যে সাংবিধানিক শপথ গ্রহণ করেছেন, সেটি পালন করবেন সে ব্যাপারে আমরা শতভাগ আস্থাশীল। আইনাঙ্গনের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রত্যেক সদস্য বিশ্বাস করে যে, আপনি আপনার বিচারিক দায়িত্ব ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সর্বক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন। বিচার বিভাগকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন অনন্য উচ্চতায়। বিচার প্রশাসনে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার জন্য আপনি সফলকাম হবেন। আমরা বিশ্বাস করি, আপনার সততা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, নিরপেক্ষতা আপনাকে এ পদে অধিষ্ঠিত করেছে। ভবিষ্যতে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও আপনি সর্বদা সততা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা এবং একনিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিবেন। আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করণে আপনি অগ্রদূত হিসেবে কাজ করবেন।’

এমএইচডি/ওএফ