লাগামহীনভাবে বাড়ছে মশার উপদ্রব। বিরক্তিকর এই পতঙ্গের প্যানপ্যানানি এবং কামড়ের যন্ত্রণাও নাহয় সহ্য করা যায়, কিন্তু এর কারণে সৃষ্ট অসুখ-বিসুখ থেকে কীভাবে বাঁচবেন? মশার কামড়ের কারণে যেসব অসুখ হতে পারে তার একটিও উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। বরং কোনো কোনো অসুখে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। গরমের সময় এলে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মশার উপদ্রব। বৃষ্টি হলে সেই পালে হাওয়া লাগে যেন। মশার যন্ত্রণায় তখন নিজের ঘরেই থাকা দায়। মশারি টাঙিয়ে আর কতক্ষণ নিজেকে রক্ষা করা যায়! একে তো করোনাভাইরাসের আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেনি, তার ওপর যোগ হয়েছে মশার অত্যাচার। এসময়ে অতিরিক্ত সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। জেনে নিন মশাবাহিত ছয়টি অসুখ সম্পর্কে-

পীতজ্বর

পীতজ্বর বা ইয়েলো ফিভার- যে নামেই ডাকা হোক না কেন, মশার কামড়ের কারণে সৃষ্ট এই রোগ যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক। জ্বর, পেশি ব্যথা, মাথা ব্যথা, জন্ডিস ইত্যাদি এই রোগের লক্ষণ। সংক্রমণের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই এই রোগ সেরে যায়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে নাক, মুখ ও পাকস্থলির রক্তপাত দেখা দিতে পারে। এই রোগের প্রকোপ থাকলে টিকা নিতে হবে।

চিকনগুনিয়া

মশার কামড়ে সৃষ্ট আরেক মারাত্মক রোগের নাম চিকনগুনিয়া। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই লক্ষণ দেখা দেয়। ত্বকের র‌্যাশ, জ্বর, মাথাব্যথা, বমিভাব ও বমি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা হওয়া এর বিশেষ উপসর্গ। অসুখ ভালো হওয়ার পরেও এই ব্যথা দীর্ঘ সময় থেকে যেতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বর

বর্ষা হলো ডেঙ্গু বহনকারী এডিস মশার সংক্রমণের মৌসুম। বর্ষাকালে এই মশার উপদ্রব অনেক বেড়ে যায়। এডিস মশা দিনের বেলা কামড়ায়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে সংক্রমণ। সংক্রমণের শিকার হলে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে তিনদিন থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এর উপসর্গগুলো অনেকটা সর্দিজ্বরের মতোই। তবে অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তখন দেখা দিতে পারে মৃত্যুঝুঁকি।

ম্যালেরিয়া

ম্যালেরিয়া মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি স্ত্রী মশা ‘অ্যানোফিলিস’ এর মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। এক্ষেত্রে প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে থাকা পরজীবী জীবাণু মশাকে আক্রান্ত করে। পরে ওই মশা সুস্থ কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে তার শরীরেও এই রোগের জীবাণু প্রবেশ করে। ম্যালেরিয়ার লক্ষণগুলো হলো জ্বর, কাঁপুনি, মাথাব্যথা ইত্যাদি।

জিকা ভাইরাস

আতঙ্কের নাম জিকা ভাইরাস। এই রোগ বহন করে যে মশা তার বৈজ্ঞানিক নাম ‘এইডেস অ্যালবোপিকটাস’। চোখ লাল হয়ে যাওয়া, পেশিতে ব্যথা ও অবসাদ হলো এই রোগের লক্ষণ। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয় না। হবু মা যদি এই ভাইরাসে সংক্রমিত হন তবে তার থেকে সন্তানের শরীরেও বাসা বাঁধতে পারে এই ভাইরাস।

এনকেফালাইটিস

এই রোগ ছড়ায় ‘কিউলেক্স’ নামক মশার মাধ্যমে। এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এশিয়া মহাদেশে। এই রোগের উপসর্গের মধ্যে রয়েছ মাথা ব্যথা ও জ্বর। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কারও কারও ক্ষেত্রে প্যারালাইসিস, মানসিক ভারসম্যহীনতা, খিঁচুনি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো এর টিকা গ্রহণ।

মশা তাড়ানোর ঘরোয়া উপায়:

পুদিনা পাতার ব্যবহার

পুদিনা পাতা ব্যবহার হয় নানারকম খাবার তৈরিতে। উপকারী এই পাতা আমাদের হজমশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। এটি কিন্তু মশা তাড়াতেও বেশ কার্যকরী। একটি গ্লাসে অল্প পানি নিয়ে তাতে পুদিনার কয়েকটি গাছ রেখে দিন খাবার টেবিলে। তিনদিন পরপর পানি বদলে দেবেন। জার্নাল অফ বায়োরিসোর্স টেকনোলোজির গবেষণা বলছে, পুদিনা পাতা মশা দূরে রাখতে সাহায্য করে। মশা ছাড়াও আরও অনেক পোকা-মাকড় দূরে থাকে পুদিনার গন্ধে। পুদিনা পাতা সেদ্ধ করে সেই পানির গন্ধ পুরো ঘরে ছড়িয়ে দিন। এতেও মশা পালাবে। 

হলুদ বাতি

আলোর প্রতি নানা রকম পতঙ্গের টান আছে এমনটাই জানি আমরা। কিন্তু আপনি জানেন কি, ঘরে হলুদ আলো জ্বাললে মশার উপদ্রব কমে? বৈদ্যুতিক বাতির চারপাশে হলুদ সেলোফন জড়িয়ে দিতে পারেন। এতে আলোর রং হবে হলুদ। আর এই হলুদ আলোর কারণে মশা দূরে থাকবে। এই রঙের আলো প্রতি সন্ধ্যায় জ্বাললে মশার আক্রমণ থেকে অনেকটাই মুক্তি মিলবে। 

চা পাতার ব্যবহার

চা পাতা কী কাজে লাগে? প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে ভাবছেন, চা পাতা তো চা তৈরির কাজে লাগে! কিন্তু চা তৈরি ছাড়াও চা পাতার আছে আরও অনেক উপকারী ব্যবহার। তার মধ্যে একটি হলো মশার উপদ্রব কমানো। সেজন্য আপনাকে যে কাজটি করতে হবে তা হলো, চা পাতা ব্যবহারের পর ফেলে না দিয়ে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। এমনভাবে শুকাবেন যেন তাতে পানি না থাকে। এরপর এই চা পাতা ধুনো হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। শুকনো চা পাতা পোড়ালে ঘরের সব মশা-মাছি দূর হবে দ্রুতই।

মশা তাড়াবে লেবু ও লবঙ্গ

এই সহজ উপায় অনেকেরই অজানা। প্রথমে একটি বড় লেবু নিয়ে দুই ভাগ করে কেটে নিন। এর ভেতরের অংশে লবঙ্গ গেঁথে নিন অনেকগুলো। লবঙ্গের ফুলের অংশটুকু শুধু বের হয়ে থাকবে। বাকি অংশ লেবুর ভেতরে গেঁথে দিন। এবার লেবুর টুকরোগুলো একটি পরিষ্কার থালায় করে কক্ষের এককোণে রেখে দিন। এতে খুব সহজেই মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে পারবেন। লেবু ও লবঙ্গ এভাবে রেখে দিতে পারেন জানালার গ্রিলেও। এতে করে মশা ভেতরে ঢুকবে না।

ফুল স্পিডে ফ্যান চালু রাখুন

মশা ভীষণ হালকা একটি পতঙ্গ। তাই ঘরের সিলিং ফ্যানটি যদি ফুল স্পিডে ছেড়ে রাখেন তবে মশা আর কাছে ঘেঁষতে পারবে না। মশার ওড়ার গতিবেগের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই ফ্যানের ঘোরার গতি বেশি। তাই মশা সহজেই ফ্যানের ব্লেডের কাছে চলে যায়। মশার উপদ্রব বেড়ে গেলে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিন।

মশা থেকে বাঁচতে সচেতনতা:

পানি জমতে দেবেন না

অনেক সময় বেখেয়ালে ঘরের বিভিন্ন স্থানে কিংবা বাড়ির আশেপাশে পানি জমে থাকতে পারে। এভাবে পানি জমতে দেবেন না। তিনদিন পরপর সেসব স্থানের পানি পরিষ্কার করুন। এতে এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ হবে। 

টব পরিষ্কার রাখুন

অনেকে বাড়ির বারান্দা কিংবা ছাদে টবে গাছ লাগিয়ে থাকেন। সেসব টবে পানি জমে থাকতে পারে। এসব জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার করুন। বাড়ির আশেপাশে আগাছা, ঝোপ-ঝাড় জমতে দেবেন না।

ঘর পরিষ্কার রাখুন

সব সময় ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। ময়লা ফেলার পাত্র ঢেকে রাখুন এবং নিয়মিত পরিষ্কার করুন। ওয়াশরুম ভেজা নয়, শুকনো রাখার ব্যবস্থা করুন।

নেট ব্যবহার

বাড়ির দরজা ও জানালায় নেট ব্যবহার করলে মশার উপদ্রব থেকে অনেকটাই বাঁচা যায়। বিশেষ করে বর্ষাকালে এই উপায় বেছে নিতে পারেন। কয়েল, স্প্রে, ক্রিম ইত্যাদিও ব্যবহার করা যেতে পারে। 

এইচএন/এএ