পাঁচ বছরের সন্তানের জন্য নিজের জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছিলেন মা। অল্প বয়সে স্বামীর মৃত্যুর পরও সন্তানের কথা ভেবে করেননি বিয়ে। আর সেই ছেলেই বিয়ের ৫ মাসের মাথায় মাকে ছেড়ে গড়েছেন আলাদা সংসার। বলছি রাবেয়া খাতুন নামে এক মায়ের জীবনের কথা।

নিজের সঠিক বয়সটাও জানেন না এই মা। তবে ধারণা করছেন ৪০-৪২ বছর হবে। বাবার অভাবের সংসারে ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় রাবেয়ার। এরপর জন্ম দেন এক পুত্র সন্তানের। ভাগ্য বদলের আশায় গাইবান্ধা থেকে এক বছরের সন্তান নিয়ে পাড়ি জমান রাজধানীতে। কিন্তু বিয়ের ৬ বছরের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান স্বামী। তখন সন্তানের বয়স ছিল ৫ বছর। আর সেই মায়ের বয়স ছিল ২০-২২ বছর। কিন্তু সন্তানের কথা ভেবে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি তিনি। কিন্তু ছেলে বিয়ে করে ৫ মাসের মাথায় মাকে ছেড়ে শুরু করেছেন আলাদা সংসার।

যেই ছেলের জন্য মা নিজেকে বিসর্জন দিলেন সেই ছেলে আলাদা সংসার গড়ায় চিন্তিত এই মা। কাকে অবলম্বন করে কাটাবেন বাকি জীবন? মায়ের মৃত্যুর খবরও কি সঠিক সময় জানতে পারবে ছেলে? সেটা নিয়েও শঙ্কিত এ মা।

আরও পড়ুন- মায়ের বেঁচে থাকাই সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার

ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এসব আক্ষেপের কথা বলেন মা রাবেয়া খাতুন। শুরুতে নিজের দুঃখের কথা বলতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও একসময় নিজের জীবনের সব কথায় ভাগ করেন তিনি।

প্রতিদিন সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচার একটি সড়কের পাশে রুটি-সবজি বিক্রি করেন এই রায়েবা খাতুন। তার ক্রেতা নিম্ন আয়ের মানুষেরা। কাজের ফাঁকেই তিনি বলেন তার জীবন যুদ্ধ আর আক্ষেপের কথা।

রাবেয়া খাতুন জানান, ২০ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় আসেন তিনি। তখন কোলে ছিল এক বছরের সন্তান। ঢাকায় আসার পর ছোট্ট একটি রুমে তাদের সংসার কোনও রকম চলছিল। কিন্তু ৫ বছরের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান স্বামী।

বাবার পরিবার কিংবা স্বামীর পরিবারের জায়গা-জমি না থাকায় আর গ্রামেও ফিরে যেতে পারেননি রাবেয়া। তাই বাধ্য হয়ে থাকতে হয় রাজধানীতে। শুরু করেন নিজের লড়াই-সংগ্রাম। সকাল বেলা রাস্তার পাশে রুটি-সবজি ও ডিম ভাঁজা বিক্রি শুরু করেন। এর পাশাপাশি একটি বাসায়ও কাজ করতেন। আর দিনের অন্য সময় কাটতো ছেলেকে নিয়ে। সন্তানও ধীরে-ধীরে বড় হতে থাকে। ছেলে বেশি লেখাপড়া করেনি। তাই কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে একটি সরকারি অফিসে অফিস সহকারীর চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু করোনার পরে ছেলে বিয়ে করে মাকে ছেড়ে গড়েছেন আলাদা সংসার। তাদের সংসারে আছে একটি সন্তানও।

রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘আমার অনেক দুঃখ। পোলারে পেটে করে বাপের বাইত (বাড়িতে) আইছি। কাম (কাজ) করে ভাত খাইছি। এরপর বাচ্চাটা হইলো। ভাঙা ঘরের মধ্যে হুইছি। একটা ত্যানা পাইনাইকা। চট গায়ে দিয়ে হুইছি (ঘুমাইছি)। অনেক কষ্ট গেছে, এই পোলারে মানুষ করতে। গ্রামের মানুষ আমারে অনেক কষ্ট দিছে। এরপর কোলে নিয়ে ঢাহা (ঢাকা) আইলাম। ৫ বছর পরেই স্বামী মারা গেল। এই যে কষ্ট শুরু হইল এহনো করতেছি। গ্রামের মানুষ আমার সব টেয়া-পয়সা খাইয়ালাইছে। বাপ-মাও মইরা গেল। আমার মাথার ওপরে মানুষ হইলে অনেক কিছু হয়ত হইতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘পোলারে মানুষ করলাম, এখন পোলা বিয়ে কইরা আমারে ছাইড়া চইলা গেছে। এই সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন রাবেয়া খাতুন। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে-মুছতে বলেন- পোলা একটু কয় না, মা তুমি আমার কাছে চইলা আও। আমি থাকি এখানে (সেগুনবাগিচা), হেরা থায়ে (থাকে) শনির আখড়া, মাঝে-মাঝে নাতিকে দেখতে যাই।’

আরও পড়ুন- মায়ের শেষ স্পর্শ

রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘এহানে (সেগুনবাগিচা) দুই ঘরের বাসা নিছি। পোলা যাওয়ার পর একটা ঘর ভাড়া দিয়ে দিছি। আরেক ঘরে একলা থায়ি। ভয় হয়, আমি মইরা গেলে পোলা হুনতে (জানতে) পারবো তো। নাহি হুনতে (জানতেই) পারবো না। জানেন, অসুখ-বিসুখ হলে কাউরে পাই না, না খাইয়া থাকতে হয়, আমার অনেক দুঃখ।’

তিনি আরও বলেন, ‘বুবুর কাছে (বড় বোন) টেয়া-পয়সা দিছিলাম, ঘর কেনার জন্য। বুবু সেটা খাইয়ালাইছে। পরে সালিশ করে ১ লাখ ২০ হাজার পায়ছি। সেটা বুবুর পোলা ও চাচা নিচে, এহনও দেয় না। গ্রামে একটা জমি থাকলেও চইলা যাইতাম, কামকাজ কইরা খাইতাম।’

স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের বিয়ে না করা প্রসঙ্গে রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘পোলার দিকে তাকাইয়া করি নাই। বহুত মানুষ কইছে বিয়া করার কথা। আমি চইলা গেলে পোলা কেমন থাকবে, এডা চিন্তা কইরা করি নাই। এহন পোলা বিয়ে কইরা আমারে হালায়া (রেখে) চইলা গেলও।’

মা দিবসের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘এডা দিয়ে কি করবো বাজান। জীবনডা গেল দুঃখে। সামনে (ভবিষ্যৎতে) কি হইবো হেডা জানি না।’

এএইচআর/এমজে