ছবি: প্রতীকী

একটা সময় থাকে, বিশেষ করে কৈশোরে পদার্পণের সেই অসহনীয় সময়। যখন পুরো পরিবেশটাকেই নিজের সংবেদনশীল মনের জন্য বেশ প্রতিকূল মনে হয়। “উফ! কী দুর্বিষহ এই জগত!” আর ঠিক সেই সময়টাতে মায়ের শাসন, উপদেশ কিংবা বারণ দুঃসহনীয় বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম বৈ কি! নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, সে সময় কেউ জিজ্ঞেস করলেই অকপটে উত্তর দিয়েছি, “বড় হয়ে বিদেশে পড়তে যেতে চাই”। কারণ সেখানে অন্তত মায়ের কড়া শাসন, বিধি-নিষেধ তো নেই। অন্তত আর যাই হোক, শত-সহস্র বেড়াজালের বাইরে নিজের মতো করে একটা জগত তো হবে! কিশোর বয়সে এই চিন্তাই কত না বিপ্লবী মনে হতো। কিশোর নয়, কিশোরী ছিলাম বলেই বিধি-নিষেধগুলোককে আরও বেশি আবদ্ধ মনে হতো সে সময়ে। 

আজ যখন ১৪-১৫ বছর পেরিয়ে এই লেখাটা লিখছি, তখন কিশোরী বয়সের অযৌক্তিক বিপ্লবী চিন্তাধারা কোথায় উবে গেছে! হাওয়াই মিঠাই কিংবা ফানুসের মতো, যেন মিলিয়ে গেল! মধ্যাহ্নের এই বেলায় বিশাল প্রশস্ত জানালাগুলো দিয়ে আসা নানা সবুজ কিশলয়ের আলোছায়ার মাঝে বুঝতে পারছি, পেরিয়ে গেছে অনেক বেলা। নিজ দেশ থেকে আজ ৮ হাজার মাইলেরও বেশি দূরত্বে বসে আছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। “বিপ্লবী চিন্তাধারার” সেসব উপাদান, সরঞ্জাম চারপাশে আছে। কিন্তু আজ সময়ের পালাবদলে মনে হয়, আসলে মা-ই আমাকে সবথেকে ভালো বোঝেন। অকপটে, নানান জটিল হিসাবের বাইরে মায়ের কাছেই সব বিনা দ্বিধায় একটানা বলে যেতে পারি। দিন শেষে ক্লাস, পাঠাগার, অফিস ডেস্কের ভগ্নাংশের মতো জটিল হিসেব শেষে যখন পাইন গাছের সারির মধ্য দিয়ে ডর্মে ফিরি, তখন মনে হয় মায়ের উৎসাহ আর সহযোগিতা ছিল বলেই তো ৮ হাজার মাইলের বেশি পাড়ি দিয়ে স্বাধীনভাবে হেঁটে চলছি। ক্লাসে শিক্ষার্থীরা যখন জিজ্ঞেস করে, “কার মতো হয়েছো?”, তখন অকপটে বলে দিতে পারি, “আমি আমার মায়ের মতো হয়েছি”। স্বাধীন, সাহসী (খুব হয়তো না!), কাজের প্রতি দায়িত্বশীল এবং হাল না ছাড়ার তাগিদ।

আমার মা বরাবরই স্বাধীন চিন্তা-চেতনার মানুষ। সমাজ কিংবা চারপাশ থেকে যখন বিভিন্ন আবদ্ধতার কথা আসে, তখন পরিবারের ইতিবাচক ভূমিকাটা মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রয়োজনীয় সেই উৎসাহ সব সময়েই পেয়েছি আমার মায়ের কাছ থেকে। দাপ্তরিক কাজ কিংবা প্রবাসের নতুন পরিবেশের বিভিন্ন আলোচনায় যখন যুক্তিতর্ক দিয়ে কথা বলেছি, সেই দৃঢ় চরিত্রটা পাওয়ার পেছনেও রয়েছে মায়ের ভূমিকা। আবার কিছুক্ষণ পরেই দাপ্তরিক সব আলোচনা শেষে, পেশাগত চরিত্রটা সরিয়ে রেখে যখন পরিবারের ছোট মেয়ের ব্যক্তিত্বটা নিলাম, অমনি অকপটে মায়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা, “আজ কোথায় কী হয়েছে”। “কী পোশাক পরতে চেয়েছিলাম, অথচ তাড়াহুড়োয় পরলাম কী”! প্রবাস জীবনে রসুইঘরে যখন রন্ধনশিল্পের নানান পরীক্ষা চলে, তখনও মাকে জিজ্ঞেস করি, “তরকারিতে রঙটা ঠিক আসছে না যে!”। “বাজার-শিক্ষার হাতেখড়ি” যখন চলছে সমান তালে, তখনও ফোন করা চাই সেই পরিচিত কণ্ঠের কাছে, “কোন মাছটা কিনলে রাঁধতে সহজ হবে, দ্রুত বলো”। 

এখন তাই ১৪-১৫ বছর পর মনে করি এবং বিশ্বাসও করি যে মায়েরা আসলে সব কিছুই জানেন। তারা সব কিছু পারেনও। অন্দরমহল থেকে বাইরের শত জটিল হিসেবও তারা সামলান নিপুণভাবে। যদিও মায়েদের সব ভূমিকাই পালন করতে হবে, এই বেড়াজালে আটকানো নেহায়েৎই ভুল। মূলত তারা যে ভূমিকাগুলো পালন করেন, সেগুলোই একটা সময় এসে নিষ্ঠার সঙ্গে নানা পালাবদলের এই চশমার ফ্রেমে ধরা পরে। 

আজ পরবাসে বসে মনে করি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের কয়েকটা বাক্য, “পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব, মাগো বল কবে শীতল হবো...।”