এক. এপ্রিল মাস চলছে। তথ্য মতে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গিয়েছে ৬১৫ জন। শুধুমাত্র ১০ এপ্রিল মারা গেছে ৭৭ জন এবং দেশে এ যাবত কালের মধ্যে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতিদিন করোনায় এত সংক্রমণ, এত মৃত্যু! কে কখন চলে যাবে, কে জানে?

আইসিডিডিআরবি (ICDDRB) এর তথ্য  মতে, আমাদের দেশে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা করোনার সংক্রমণ হচ্ছে। গত মাসের ১২ থেকে ১৭ মার্চের মধ্যে ৯৯টি করোনা রোগীর নমুনা বিশ্লেষণ করে ৬৪টি অর্থাৎ ৬৪ শতাংশের বেশি দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এরপর ১৮ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে করোনা রোগীদের ৫৭টি জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ৪৬টি অর্থাৎ ৮০ শতাংশেরও বেশি দক্ষিণ আফ্রিকার করোনা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এটা আমাদের জন্য দুঃসংবাদ। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার এই ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এর সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি।

দুই. জরুরী একটা প্রয়োজনে বের হয়েছিলাম। বাড়ির সামনে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। পাশেই মাস্ক ছাড়া তিনজন খোশমেজাজে গল্প করছে। হঠাৎ একজন আরেকজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‌‌‘তাড়াতাড়ি মাস্ক পর, পুলিশ আইছে’। কথাটা শোনার পর মনে হলও, আমরা আর কবে সচেতন হবো? গত বছর করোনার কারণে যখন দিনে ২০-২২ জন মারা গেছে, তখন আমরা ভয়ে আঁতকে উঠেছি। বেঁচে থাকলে, ভালো কাজ করার প্রতিজ্ঞা করেছি। অথচ এই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা অনেক কিছুই ভুলে গেছি। সঙ্গে সচেতনতাটুকুও।

তিন. রাস্তায় একজন বয়স্ক লোক আরেকজন কে জিজ্ঞেস করছে, ‘করোনায় আইজকে কয়জন মরলো’? মৃত্যু নিয়ে কতটা হেঁয়ালি প্রশ্ন হতে পারে, প্রশ্নটি শোনার পর বুঝতে পারলাম। আমাদের মন মানসিকতা কত নিচে নেমে যাচ্ছে! করোনার ভয়াবহতা আমরা মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে নির্ণয় করছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা ভয়ঙ্কর রকমের নির্দয় হয়ে উঠেছি। একমাত্র নিজেদের সমস্যা ছাড়া, আর কোন কিছু আমাদের স্পর্শ করে না। একটা পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি মারা যায়, তাহলে সেই পরিবারের কি অবস্থা কোথায় দাঁড়ায়? মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর মানুষ তো পথে বসে যায়।

চার. যারা এখনো অবহেলা করছেন, জ্বর, সর্দি, কাশি হলেই টের পাবেন করোনার‌ বর্তমান পরিস্থিতি। আর শ্বাসকষ্ট হলে তো কথাই নেই। হাসপাতালে ভর্তি হবার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। আইসিইউ বেডের স্বল্পতা রয়েছে। ১০,০০০ টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার ৩০,০০০ টাকায়ও পাবেন না। চোখের সামনে আপন মানুষের চলে যাওয়া। কারও কিছু যায় আসে না। কিন্তু যাদের প্রিয় মানুষটি চলে যাচ্ছে, তাদের জন্য তো বিরাট ক্ষতি। সবাই সাবধানে থাকুন, সতর্ক থাকার চেষ্টা করুন।

পাঁচ. এই কথাটা আমাদের প্রায়ই শুনতে হয়। জীবনের জন্য জীবিকা নাকি জীবিকার জন্য জীবন? ভিন্ন ভিন্ন উত্তর আসতে পারে। করোনার এই দুর্যোগে তর্ক করার সময়ে এখন নেই। কারণ প্রেক্ষাপটের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এজন্য সমন্বয় করে চলতে হয়।

আমাদের মধ্যে সবসময় একগুয়েমি একটা ভাব কাজ করে। একটু ঘাড় ত্যাড়াও বলা যেতে পারে। যেটা না করতে বলা হয়, সেটাই সবার আগে করার চেষ্টা করি। যেটা নিজেরা ভালো বুঝি, মনে করি সত্যি। কেউ কোন উপদেশ দিলে, সবার আগে আমরা সেটা অগ্রাহ্য করতে চেষ্টা করি। আসলে আমাদের যে কেউ ভালো চাইতে পারে, সেটা বিশ্বাস করার সময়টুকুও নেই। তবে একগুয়েমির কিন্তু অনেক ভালো দিকও আছে, যদি আমরা ভালো কোন কাজে নিজেদের নিয়োজিত করি। একগুয়েমির কারণে অনেকে সারারাত ধরে লেখাপড়া করে, অনেকে ব্যবসায় বা চাকরিতে দিনরাত পরিশ্রম করে, অনেকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গবেষণা করে নতুন কিছু করার আশায়। একগুয়েমির মধ্যে নিজেকে জাহির করার একটা বিষয় থাকে।

করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। সাবধানতার কোন বিকল্প নেই। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাড়ির বাইরে বের হওয়া উচিত না। বাঁচতে চাইলে একগুয়েমি করে হলেও ঘরে থাকুন। কারণ করোনার কারণে মৃত্যু অনেক সহজ হয়ে গেছে। একারণে সকলেই সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক