এক. আমি খাওয়া দাওয়ার প্রতি সবসময় একটু খেয়ালি। মনের মত খাবার না হলে খেতে পারি না। ছোট থাকতে চিংড়ি মাছটা খেতে খুব পছন্দ করতাম। হলুদ, পিঁয়াজ দিয়ে জ্বালানো চিংড়ি মাছ। সেই সময় বাসায় ফ্রিজ ছিল না। প্রতিদিন বাসায় বাজার করা হত। সকাল বেলা বাসায় প্রতিদিনের মেন্যু ছিল ভাত, আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি। আমার ডিম ভাজি খেতে ভালো লাগত না। এই জন্য সকালে ভাত খেতে একটু দেরি করতাম। কখন বাসায় বাজার আসবে সেই অপেক্ষায় থাকতাম। কারণ প্রতিদিন চিংড়ি মাছ কেনা হত। বাজার আসার সঙ্গে সঙ্গে মা বাজারের ব্যাগ থেকে কিছু চিংড়ি মাছ বেছে তেল, পিঁয়াজ, হলুদ দিয়ে আমার জন্য জ্বালিয়ে দিত। আমি যদি কিছু ভাত বেশি খেতে পারি, তাতেই যেন মায়ের শান্তি। সেই অবস্থা এখনো চলছে। বাঁচো আর মরো, আমাকে খেতে হবে। আমি এখনো অবুঝ, আমার মায়ের কাছে

প্রতিটা সন্তান মায়ের কাছে আরাধ্য। প্রথম সন্তান হয়তো আরো বেশি প্রিয় হয়ে থাকে। কোন মা হয়ত মুখে স্বীকার করবে না। আমরা তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার বড়। মেজো ভাই (আমার চেয়ে বছর তিনেক ছোট) একবার  মা’কে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘মা তুমি ভাইয়াকে বেশি ভালবাসো, তাই না’? মা আমাকে পরে এই কথাটা বলেছিল। মা কথাটি শুনে হেঁসে উড়িয়ে দিয়েছিল। আমি জানি, আমার মেজো ভাই এই লেখাটা পড়বে আর একটু আধটু লজ্জাও পাবে। কারণ সবার সামনে বলে ফেললাম। তবে মা আমাদের তিন ভাইয়ের প্রতিই অত্যন্ত যত্নবান। সহায় সম্পদ বলতে যেন আমরা তিন ভাই। এক অদৃশ্য ভালোবাসা বহন করে চলেছেন।

দুই.  যখন স্কুলে পড়তাম, মা বইয়ের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে নিত। আমি যদি সেই বইয়ের উত্তরের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া বলতে না পারতাম, তবে বিকালে মাঠে যাওয়ার অনুমতি মিলত না।

যখন মাঠে খেলতে যেতাম, বেলা একটা/দেড়টা কিংবা সন্ধ্যা হয়ে গেলে খুলনার রেলওয়ে লোকো মাঠের কোনায় মাথায় কাপড় দিয়ে মা চলে যেতেন। সবাই বলতো, কাকি আসছে, চলে যা। তখন মায়ের উপর একটু আধটু রাগ হত। আরেকটু পর আসলে কি হত? আরেকটু বেশি খেলতে পারতাম। মা'কে যেতে বললেও যেত না। দাঁড়িয়ে থাকত। বকাবকি করত না। তবে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকলে অনেক সময় বলত, তোদের আব্বা বাসায় আসবে, তাড়াতাড়ি আয়। যাই হোক, আমাদের মা ও চাইতো আমরা আরেকটু খেলি। কিন্তু আব্বা এসে আমাদের না দেখলে হয়ত রাগারাগি করবে। এইজন্যই সাথে নিয়ে যেতে চাইত। আমরা দুই ভাই তখন মায়ের পিছু পিছু বাসায় চলে যেতাম।

স্কুলে পড়াকালীন সময়ে, সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ৯টা মোটামুটি বিদ্যৎ থাকত না। আইপিএস এর কথা সেই সময় চিন্তা করার সুযোগ ছিল না। চার্জারের ফ্যানও তখন বাজারে আসে নি। যাই হোক, সন্ধ্যার পর কারেন্ট চলে গেলে ঘরের বাইরে গেলে মা তেমন একটা কিছু বলতো না। তবে যদি পড়তে থাকতাম, তবে পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতো। যত সময় পড়তাম, মায়ের হাতপাখা থামতো না। কখনো মাথায় আসে নি,মায়ের কি হাত ব্যথা হয়না?

আবার রাতে ঘুমের মধ্যেও বিদ্যুৎ চলে যেত। তবে সে সময় টের পেতাম না। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ হাতপাখা গায়ের সাথে লেগে যেত। তখন বুঝতে পারতাম, মা বাতাস দিচ্ছে। কিন্তু তিনি না ঘুমিয়ে যে বাতাস দিচ্ছে, তাঁর তো কষ্ট হচ্ছে,  তখনো মাথায় আসতো না।

তিন. আমার এসএসসি, এইচএসসি, এমনকি বিবিএ, এমবিএ’র পরীক্ষার সময়ও মা রোজা রাখতেন। আল্লাহর কাছে চাওয়াগুলো হয়ত আল্লাহ পূরণ করে চলেছে। আমরা দুই ভাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছি। ছোট ভাইটা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ শেষ করলো। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা তিন ভাই বাবা-মায়ের সঙ্গে ভালো আছি। এখন একটা প্রশ্ন অনেকের কাছ থেকে শুনতে হয়, আমার সঙ্গে বাবা-মা থাকে কিনা? কি বোকার মত প্রশ্ন। আমার সঙ্গে বাবা-মা কেন থাকবে? আমিই তো আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকি। এখনো বাড়ির সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বাবা-মা।

চার. মায়ের শরীরে রক্ত স্বল্পতার কারণে হেমোফার আয়রন ইনজেকশন দিতে গেলাম। আমার এক কাজিনের চেম্বারে যেয়ে দিতে হবে। আমি মায়ের সঙ্গে ছিলাম। মায়ের হাতের শিরায় ইনজেকশন দেওয়া  হলো। প্রতি মিনিটে ১২ ফোটা। বুঝলাম তিন ঘন্টার বেশি সময় লাগবে। ৩০ মিনিট পার হবার মা বুঝতে পারলো,  কৃত্রিমভাবে রক্ত বৃদ্ধির এই আয়রন ইনজেকশন শেষ হতে বেশ সময় লাগবে।

মা বললো, চলে যা।

-আমি থাকি। সমস্যা নেই।

আমার শেষ হলে আমি চলে যেতে পারবো। তুই যা। একা একা বসে থেকে কি করবি? (আসলে রুমের মধ্যে ফ্যান চালালে মা’র খুব ঠান্ডা লাগছিল। আমি বসে থাকলে গরমে আমার খুব কষ্ট হবে। আমাকে চলে যেতে বলার এটাও একটা কারণ ছিল)

তুই বাসায় যা। আমি একটু ঘুমাই।

-তুমি ঘুমাও।

আমি পাশে বসে মোবাইলে গেমস খেলতেছি।

তিন ঘন্টা ধরে মায়ের হাতে হেমোফার আয়রন ইনজেকশন ছিল। আমি থাকলাম। মা’কে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি আর ভাবছিলাম, আমি অসুস্থ হলে মা’কে যতই বলি, সে কি হাসপাতালে আমাকে রেখে  বাসায় আসতে পারতো? কখনোই না। 
মা বলে কথা। আর আমি যদি তাকে যেতে বলতাম, নিশ্চিত গালাগাল শুনতে হত।

চার. বছরে তিন চার বার আমার জ্বর হয়ে থাকে। এখনো জ্বর হলে, মায়ের মুখের দিক তাকালে মনে হয় সে যেন আরো অসুস্থ। মায়েরা যে কেন এমন হয়, বুঝতে পারাটাই মুশকিল। আমার যদি উঠতে কষ্ট হয়, তাহলে বালিশের নীচে রেক্সিন দিয়ে মাথায় পানি ঢালবে। ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দেবে। কি খেতে পারবো, সেই চিন্তাই যেন সবসময় তাঁর মাথায় ভর করে থাকে।

যাদের ঘরে মা আছে, তারা মায়ের হাত দুটো একদিন ধরে দেখবেন। কতটা অযত্নে বছরের পর বছর কেটে গেছে, মা হয়তো নিজেও জানে না।বিয়ের আগে যে মানুষ প্রতিদিন চুলে শ্যাম্পু করতেন, সে এখন বিশেষ কোন দিন ছাড়া  শ্যাম্পু করে সময় নষ্ট করার কথা ভাবতেই পারে না।সবই তো আমাদের জন্য।ভালো করে একদিন তাঁর মুখের দিকে তাকান।দেখবেন, সন্তানের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনেক  আকুতি লুকিয়ে আছে।শুধু বলতে পারে না। যাদের বাবা-মা বেঁচে নেই, দোয়া করুন তাদের জন্য।

পাঁচ. একটা পুরানো ঘটনা। রাত ১১ টার দিকে রিক্সায় করে বাসায় আসতেছি। হঠাৎ অল্পবয়সী রিক্সাওয়ালা ছেলেটার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।ওই পাশ থেকে কে ফোন করেছিলো, কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। তবে ছেলেটার কথা ছিল ঠিক এই রকম, “ আমার আব্বা আমার দাদা-দাদিরে খাওয়াইছে, পরাইছে। আমিও আমার আব্বারে-মায়েরে খাওয়াবো। আমার মা আমার দাদা-দাদিরে নিয়া থাকছে। আপনার মাইয়ারও শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়া থাকতে হবে। আপনার মাইয়া মানতে পারলে সংসার করুক, না পারলে না করুক”।

কথাটা বলে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো।যেন কিছুই হয়নি। রিক্সা চলছে।মনে মনে ভাবলাম, একটা বাঘের বাচ্চা।বিরাট বিরাট শিক্ষিত হয়ে কয়জন ছেলে এইভাবে বলতে পারে? ধন্য ওই রিক্সাওয়ালার বাবা-মা।সন্তান মানুষ হওয়া বলতে হয়তো এটাই বুঝায়।

ছয়. আজ বিশ্ব মা দিবস। দিনটাতে সবাই মায়েদের কথা বলছে। তবে আমাদের উচিত, আজকের দিনের মত প্রতিটা দিনই মায়েদের কথা বলা। সন্তানদের কাছে থেকে ভালো থাকুক প্রতিটা মা।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক