ছবি যেন শব্দহীন যোগাযোগের বিমূর্ত প্রতীক-এই কথাটিই জীবন্তভাবে ধরা দেয় বিশ্বের নানা শিল্পীর চিত্রকর্মের মাধ্যমে। শিল্পী তার মনের মাধুরী মিশিয়ে ক্যানভাসে, রং তুলিতে ফুটিয়ে তুলতে পারেন কল্পনার ভাষাকে। তেমনি একজন চিত্রকর্ম শিল্পী প্রজ্ঞা লাবনী। পেশায় তিনি একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী, একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ছবির রং, আঁকার বিষয় নিয়ে নিজের ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলছেন নিজ চিত্রকর্মে। চাকরির পাশাপাশি প্রতিদিনই এ কাজে সময় দেন তিনি।

যদিও চাকরি করে এমন শখ ধরে রাখা এতটা সহজ নয়, তবুও হাজারো ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে ঘুরে ঘুরে এই চিত্রকর্মেই ফিরিয়ে নিয়ে আসেন তিনি। অংশ নিয়েছেন অসংখ্য প্রদর্শনীতে। দেশি প্রদর্শনীতে যেমন সুনাম কুড়িয়েছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতেও প্রশংসায় ভেসেছে তার চিত্রকর্মগুলো। ক্যানভাসে আঁকা রঙিন ছবিতে সজ্জিত তার দেয়াল, মনোমুগ্ধকর প্রতিটি ছবি যেন মনের কথাই বলে যাচ্ছে। রং, তুলি যেন প্রতিটি স্থান স্পর্শ করে আছে তার জীবনের।

পেশায় প্রকৌশলী হলেও চিত্রকর্ম নিয়ে আলাপকালে প্রজ্ঞা লাবনী জানিয়েছেন অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এক্সিবিশনে অংশ নিয়েছেন তিনি। তার এক্সিবিশনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অ্যাডওয়ার্ড এম. কেনিডি সেন্টারের আয়োজনে আস ওমেন ২০২২ এক্সিবিশন, কালার ফ্লো আর্ট এক্সিবিশন, দ্যা ম্যাজিক্যাল ব্রাশ আর্ট এক্সিবিশন, শিল্প বাংলা আর্ট এক্সিবিশন; যেখানে স্বশরীরে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।

এছাড়া অনলাইনের মধ্যে আন্তর্জাতিক এক্সিবিশন, ফাস্ট ইন্টার‌ন্যাশনাল অনলাইন মেনিয়েটর আর্ট এক্সিবিশন, রাশিয়া-ইন্ডিয়া কালচার এক্সচেঞ্জের আয়োজনে দ্যা অনলাইন ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন, ইউনাইটেড নেশন-বাংলাদেশের আয়োজনে ডিজিটাল আর্ট কমপিটিশন এক্সিবিশন ‘শেপিং আওয়ার ফিউচার টুগেদার’, ইন্টারন্যাশনাল আর্ট কমপিটিশন ‘এক্সপ্রেশন’ বিউটি অব ওয়াটারে অংশ নেন তিনি।

পাশাপাশি ব্ল্যাক পারপেল আর্ট কনটেস্ট ডায়মন্ড অ্যাওয়ার্ড, স্প্রিং-স্টিল-স্পেশাল গোল্ড অ্যাওয়ার্ড, অ্যানুয়াল ইন্টারন্যাশনাল অনলাইন মেনিচার আর্ট কনটেস্ট অ্যান্ড এক্সিবিশন ইনসাইট, ইন্টারন্যাশনাল কনটেস্ট এক্সপ্রেশন-থিম স্টিল লাইফ এক্সিবিশনে স্থান পায় প্রজ্ঞা লাবনীর চিত্রকর্ম।

আন্তর্জাতিক এসব প্রদর্শনীর পাশাপাশি জাতীয় আরও অনলাইন এক্সিবিশনে তিনি অংশ নিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- আর্ট ভারসেস আর্টিস্ট ফ্ল্যাশ ইভেন্ট, মাই ফেভারিট পেইন্টিং ফ্ল্যাশ ইভেন্ট, কেপিআর অ্যাওয়ার্ড কম্পিটিশন, স্বাধীনতা প্রপঞ্চ, ন্যাশনাল নলেজ কার্নিভাল, কালচারাল ভিশন, স্বাধীনতা উৎসব, বঙ্গবন্ধু শিল্পকলা প্রতিযোগিতা, স্বর্ণাভ স্বাধীনতা এক্সিবিশন।

চাকরির পাশাপাশি এত সব ইভেন্টে অংশ নেওয়া, সময় দেওয়া, মনের ক্যানভাসে কল্পিত ছবিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হয় শিল্পী প্রজ্ঞা লাবনীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাত

ঢাকা পোস্ট : ছবি আঁকার বিষয়টাকে কীভাবে বেছে নিলেন?
প্রজ্ঞা লাবনী : দেশের প্রসিদ্ধ স্কুল থেকে লেখাপড়া করার কারণে ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকা, সেলাই, বিতর্ক, সঙ্গীত সবকিছু চর্চা করার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে ছবি আঁকার শখ ছিল প্রবল, রং নিয়ে নাড়াচাড়া করতে, খাতা রাঙাতে বরাবরই ভালো লাগত, বরাবর ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে চিত্রশিল্পী হব। সেই থেকে শুরু করে এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি।

ঢাকা পোস্ট : আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার ছবি আঁকা শিখলেন কীভাবে?
প্রজ্ঞা লাবনী : আমি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি ছবি আঁকার তালিম দেওয়া হয়। কিন্তু লেখাপড়ার ব্যস্ততার কারণে নবম শ্রেণি থেকে আর ছবি আঁকার চর্চা করা হয়নি। বহু বছর পর ২০১৬ সালে আবার ক্যানভাসে পেইন্টিং করা শুরু করি। মূলত ইউটিউব এবং পিন্টারেস্ট এর বিভিন্ন ভিডিও দেখেই নিজে নিজে একজন বিগেনার হিসেবে ছবি আঁকা শুরু করা।

ঢাকা পোস্ট : চাকরির পাশাপাশি ছবি আঁকার জন্য সময় বের করেন কীভাবে?
প্রজ্ঞা লাবনী : যেহেতু এক একটি ছবি আঁকতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়, চাকরি করে সময় ম্যানেজ করা আসলেই কষ্টসাধ্য। তবে যেহেতু আমার এই দিকটায় অন্য রকমের ভালোলাগা আছে তাই চাকরি করেও রাতে এখানে সময় দিতে ভালো লাগে। মূলত রাতের সময় এবং সাপ্তাহিক বন্ধের দিন ছবি আঁকার কাজে বেশিরভাগ সময় ব্যয় করা হয়।

ঢাকা পোস্ট : ছবি আঁকার বিষয়টি আপনার পরিবার কীভাবে দেখে?
প্রজ্ঞা লাবনী : ছবি আঁকার ব্যাপারে আমার বাবা-মা শুরু থেকেই অনেক সাপোর্টিভ। তবে শুরুর দিকে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে এমন শুনতে হয়েছে যে ছবি এঁকে কী হবে? এখন যখন আমার আঁকা ছবি নিয়ে জাতীয় আন্তর্জাতিক অনেক প্রদর্শনীতে অংশ নেই তখন অনেকেই অবাক হয়ে যায়।

ঢাকা পোস্ট : ছবি আঁকার শুরুটা কীভাবে?
প্রজ্ঞা লাবনী : ২০১৬ সালে ‘হোপ’ নামের একটি ছবি দিয়ে আমার ছবি আঁকা শুরু। ছবিটি এক্রেলিক কালার দিয়ে ক্যানভাস পেপারে আঁকা। ছবিটিতে একটি মেয়ের মুক্তভাবে বেঁচে থাকার দৃশ্য কল্পনা করা হয়েছে। ছবি আঁকার জন্য আমি অ্যাক্রেলিকের পাশাপাশি তেল রং ব্যবহার করে থাকি। এছাড়াও আমি বিভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করার চেষ্টা করি সেখানে ক্যানভাস, ক্যানভাস পেপার, হ্যান্ড মেড পেপার ব্যবহার হয়ে থাকে, সঙ্গে থাকে তুলি, নাইফ এবং বিভিন্ন টেক্সচার এর ব্যবহার। এছাড়া আমি মিক্স মিডিয়াতেও কাজ করে থাকি।

ওমেন স্ট্রেংথ নামক মিক্স মিডিয়াতে করা আমার একটি কাজ ইকেএম সেন্টারে প্রদর্শিত হয়। এই ছবিতে পেপার কাটিং, নাইফ এবং ব্রাশ এর মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতিতে, প্যানডেমিকে নারীদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। এই ছবির অনেকেই প্রশংসা করেছেন।

ঢাকা পোস্ট: ব্যক্তি জীবেনের গল্প কিছুটা শুনতে চাই।
প্রজ্ঞা লাবনী : আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেছি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিষয়ে মাস্টার্স করেছি। পরিবারে আমি ও আমার বাবা-মা আছেন। বাবা-মার সঙ্গে ঢাকাতেই বসবাস করছি। আমার বাবার নাম প্রিয়রঞ্জন মহাজন, তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জেনারেল ম্যানেজার পদে আছেন। আর আমার মায়ের নাম কুমকুম মহাজন, তিনি একজন গৃহিণী। ছবি আঁকার ইচ্ছে ছোটবেলা থেকেই। তবে ২০১৬ সালে প্রথম ক্যানভাসে ছবি আঁকা শুরু করি। সম্পূর্ণ শখের বশে আর ভালো লাগা থেকে ছবি আঁকা শুরু। 

ঢাকা পোস্ট : কী ধরনের ছবি আঁকেন বেশি? ছবি আঁকার পাশাপাশি আর কী করতে ভালো লাগে?
প্রজ্ঞা লাবনী : আমি মূলত একজন ল্যান্ডস্কেপ অয়েল পেইন্টিং আর্টিস্ট। তবে মিক্স মিডিয়া ইউজ করে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট করতেও আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ছবি আঁকার পাশাপাশি গার্ডেনিং, গান এবং বিভিন্ন ধরনের রান্না করার শখ আছে।

ঢাকা পোস্ট : ছবি আঁকতে গিয়ে কী কী চ্যালেঞ্জ ফেস করেন? একটি ছবি আঁকতে কেমন সময় লাগে?
প্রজ্ঞা লাবনী : চিত্রশিল্পী হিসেবে চ্যালেঞ্জটা সবসময় ফেস করতে হয়। তবে প্রত্যাশা থাকে উপযুক্ত প্লাটফর্মে নবীনদের, যারা নিজ প্রচেষ্টায় চিত্রকর্ম শিখেছে তাদের সুযোগ দেওয়া জরুরি। এই জায়গাটাই সবার নজর দেওয়া, উদ্যোগী হওয়া জরুরি। এই ক্ষেত্রটাকে এগিয়ে নিতে হলে তাদের জন্য এক্সিবিশন এবং মূল্যায়নের আরও প্লাটফর্ম তৈরি করতে হবে। এটা নতুনদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জের জায়গা। আর ছবি আঁকার সময় বিষয়ে যদি বলি তাহলে আমার বেশিরভাগ ছবিই বড় ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা। সেই ছবিগুলো আঁকতে সর্বোচ্চ সময় লাগে দুই থেকে তিন সপ্তাহ।

ঢাকা পোস্ট : এই বিষয়ে আগ্রহী অন্য নারীদের জন্য কী বলার আছে?
প্রজ্ঞা লাবনী : অবশ্যই নারীদের উচিত চাকরি এবং ঘর সামলানোর পাশাপাশি নিজের শখকে প্রাধান্য দেওয়া। তা হতে পারে চিত্রকর্ম, গার্ডেনিং অথবা সেলাই। শখকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করলে তা অন্যতম আয়ের উৎসও হতে পারে।

ঢাকা পোস্ট : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় কোথায় নিয়ে যেতে চান নিজেকে? 
প্রজ্ঞা লাবনী : চিত্রকর্ম নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো দেশের বাইরে আমার চিত্রকর্ম প্রদর্শনী করা এবং একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। এখন আমি অবসর সময়ে কিছু শিশুকে আর্ট শেখাই। পাশাপাশি প্রচুর এক্সিবিশনে অংশ নিতে চাই নিজের ছবি নিয়ে। এক্সিবিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন গুণী শিল্পীদের কাজ সামনে থেকে দেখা যায়, এতে একটি বিশাল প্লাটফর্ম তৈরি হয়, বিভিন্ন গুণী আর্টিস্টদের সান্নিধ্যে এসে তাদের কাজ দেখে নতুন অনেক কিছু শেখা যায়।

এএসএস/জেডএস