যেখানে নিয়ম করে দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়াতাম হরেক বই, প্রকাশক আর বইমেলার অফুরন্ত নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে, সেখানে বাধ সাধে করোনা মহামারি। দুই বছরের মতো অনেক আয়োজন স্থগিত থাকার পর যখন একটু একটু করে সব আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে, তখনও একপ্রকার দূরেই ছিলাম সেসব আয়োজন থেকে। 

এর মধ্যে একদিন হঠাৎ মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিশুতোষ বইমেলার সামনের আসরে অংশগ্রহণের বিশেষ আমন্ত্রণ! মহামারির শঙ্কা তখনও আছে, তবে মহা বইমেলা আয়োজকের ইমেইল পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয়নি। 

ইতালির বোলোনিয়া শহরে শহরটির নামানুসারে বসে শিশুদের বইয়ের সবচেয়ে বড় এ মেলা।  ১৯৬৩ সাল থেকে গুটি গুটি পায়ে এর যাত্রা শুরু। কয়েক বছরের মধ্যেই ‘বোলোনিয়া শিশুতোষ বইমেলা’ ছোটদের বইয়ের লেখক-শিল্পী-প্রকাশকদের মহামিলনমেলায় পরিণত হয়। মেলাটি মূলত বইয়ের স্বত্ব কেনাবেচার আসর, যেখানে প্রকাশক ও এজেন্টরা তাদের বইয়ের অনুবাদ ও প্রকাশনা স্বত্ব অন্য প্রকাশক বা এজেন্টের কাছে বিক্রি করে থাকেন। 

কেনাবেচা তো থাকেই, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শিশুদের প্রকাশনার জগতে নতুন কী হচ্ছে তা জানা ও দেখার জন্যও এই মেলার জুড়ি নেই। আরও থাকে নানা রকম প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের আয়োজন। 

কোভিডের কারণে ভ্রমণ অতিরিক্ত জটিল হওয়ার পরও খুব একটা সমস্যা ছাড়াই আমি বোলোনিয়া বইমেলায় পৌঁছতে পেরেছিলাম। মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালের বইমেলা বাতিলের পর এবারই বসেছিল প্রথম আসর। এই আসরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সফল ও প্রতিশ্রুতিশীল উনত্রিশ জন প্রকাশক বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। আমন্ত্রিত প্রকাশকদের স্টল বরাদ্দ, প্রথম শ্রেণির বিমান টিকেট, থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তসহ যাবতীয় খরচ বহন করেছে মেলা কর্তৃপক্ষ। এমন একটি আয়োজনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে ময়ূরপঙ্খি বিশেষভাবে গর্বিত।  

ময়ূরপঙ্খির স্ট্যান্ড ছিল ওয়ার্ল্ড লাউঞ্জে। ঠিক বিপরীতেই হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন পাবলিশিং। খুব ভালো জায়গায় আমরা স্ট্যান্ড পেয়েছিলাম। মেলায় আগত দর্শনার্থীরা আসা-যাওয়ার সময় স্ট্যান্ডের সামনে থামার এবং আমাদের বইগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।

আমি আগেও একবার এই বইমেলায় গিয়েছিলাম ২০১৭ সালে।  তখন ময়ূরপঙ্খি সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছে, বইয়ের সংখ্যা হাতে গোনা।  এবার ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা। ওজনে যতটুকু কুলায়, তার সবটা খরচ করে আমাদের অনেক অনেক বই সাথে করে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। রীশাম শাহাব তীর্থ চিত্রিত তার মেয়েকে নিয়ে যাপিত জীবনের গল্প ‘বাবুইবেলা গ্রন্থমালা’, শামীম আহমেদ চিত্রিত ও বহ্নি বেপারী লিখিত ‘নদীর গল্প’, সব্যসাচী মিস্ত্রী চিত্রিত বইগুলো এবং আরও কিছু বই ভিনদেশি প্রকাশক-এজেন্টদের নজর কেড়েছে। কেউ কেউ বইগুলো তাদের ভাষায় প্রকাশে আগ্রহও দেখিয়েছে। এর মধ্যে আমাদের একটা বই স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। 

করোনার পর এই মেলাতে পেশাদার প্রকাশকদের উপস্থিতি আগের তুলনায় কম থাকলেও সংখ্যাটি কিন্তু অন্য অনেক অনেক আন্তর্জাতিক বইমেলা থেকে বেশি। আমার প্রধান কাজ ছিল অন্য প্রকাশকদের সাথে মিটিং করা। যখন আমার কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকত না, তখন আমি বিভিন্ন হলের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে কাটাতাম। অন্যান্য প্রকাশকের প্রদর্শনীতে কী আছে তা দেখতাম। ব্যতিক্রমী কিছু পেলে সেগুলো খুঁটে খুঁটে দেখার চেষ্টা করতাম। এছাড়া, আমাদের বইগুলো যতটা সম্ভব অন্যদের দেখানোর চেষ্টা করতাম। 

মেলায় প্রবেশপথের কাছেই ছিল আঁকিয়েদের দেয়াল — আয়োজকদের ভাষায় ‘ইলাসস্ট্রেটর’স ওয়াল’। সেই দেয়ালগুলো শিল্পকর্মে ঢাকা। প্রায় সব ছবির ঠিক নিচে শিল্পীদের ভিজিটিং কার্ড। বোলোনিয়ার এই দেওয়ালের অনুসরণে বিশ্বের অনেক বইমেলায় এখন এরকম দেয়ালের দেখা মেলে। দেওয়ালে ঝোলানো শিল্পকর্মগুলো ছিল এক কথায় চমৎকার। তবে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, বেশির ভাগ শিল্পকর্ম অন্ধকারে ঢাকা ও বিমূর্ত। আমাদের দেশে যেখানে শিশুতোষ বই মানেই অত্যাধিক রঙিন কিছু বোঝায়, সেদিক থেকে এগুলো বেশ ভিন্ন অভিজ্ঞতাই বটে।

‘নির্বাক বই প্রতিযোগিতা’ নামে একটি অবিশ্বাস্য আয়োজন আমার মন কেড়েছিল।  কোনো লেখা ছাড়া শুধু ছবি দিয়ে তৈরি বইও যে কত কথা বলতে পারে তা কে জানত! লেখা যখন নেই, তখন চিত্রভাষার শক্তিকে আরও নানাভাবে কাজে লাগানোর দুর্দান্ত সব নজির দেখে আমি নির্বাক বইয়ের একপ্রকার ভক্তই বনে গেছি! 
 
এখানে বলে রাখা ভালো, ‘নির্বাক বই’ পড়ার সময় শিশুরা প্রথম থেকে শুরু করে একেবারে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ছবির শক্তিকে উপভোগ করতে পারে। তারা নিজেদের ভাষাতেই বুঝে নেয় গল্পটা কিভাবে এগোচ্ছে, একেকজন হয়তো একেকভাবে। এছাড়া একই পাঠক একেক সময় একেকভাবে গল্প সাজাতে পারে। নির্বাক বইয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা, এ ধরনের বই শিশুর কল্পনাশক্তি বিকাশে সহায়তা করে। শিশুদের প্রধানত দৃষ্টিনির্ভর চিন্তার সাথে মিল রেখেই এ ধরনের বই তৈরি করা হয়। ময়ূরপঙ্খি এই ধরনের একটি বইয়ের দুইটি সংস্করণ প্রকাশ করেছে। 

আয়োজকদের উষ্ণ আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। পরিচয় হয়েছে অনেক নতুন প্রকাশক ও এজেন্টের সাথে। অনেক দিন পর কিছু পরিচিত মুখ ও বন্ধুদের সাথেও দেখা হয়েছে।

মেলার তৃতীয় অর্থাৎ শেষ দিন কিছুটা সময় বের করতে পেরেছিলাম আশপাশে ঘুরে দেখার জন্য। এর মধ্যে যার কথা না বললেই নয় তার নাম পিয়াজ্জা দেল নেতুনো এবং এর অন্তর্ভুক্ত পালাজো রে এনজো প্রাসাদ। এই প্রাসাদেই ১৯৬৩ সালে বোলোনিয়া বইমেলার প্রথম সংস্করণ অনুষ্ঠিত হয়। আর এখানেই এ বছরের বোলোনিয়া রাগাজি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানও হয়েছে। এই পুরস্কারকে বলা হয়ে থাকে শিশুতোষ বইয়ের অস্কার। স্বপ্ন দেখি আমাদের বইও একদিন প্রকাশনায় এই স্বীকৃতি অর্জন করবে।

সারা দুনিয়ার শিশুতোষ বইয়ের জগতে কী অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ যে হচ্ছে তা একসাথে এক জায়গায় দেখার অপূর্ব সুযোগ করে দিয়েছিল বোলোনিয়া। বইপত্র কিভাবে ভাষায় ভাষায়, জাতিতে জাতিতে, সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে সেতুবন্ধন রচনা করে, কিভাবে তাদের মধ্যে একাত্মতা ও বন্ধুত্ব গড়ে তোলে তা আরও একবার স্পষ্ট করেছে বোলোনিয়া শিশুতোষ বইমেলা। 

উল্লেখ্য, ময়ূরপঙ্খি ২০২১ সালে আমন্ত্রিত হয়ে ফ্রাঙ্কফ্রুট বইমেলায় যোগ দিয়েছিল। 

এনএফ