ছবি : সংগৃহীত

বিশেষ কোনো কোটার সুযোগ ছিল না, কেবল নারীদের মধ্যেই প্রতিযোগিতা বিষয়টা তেমনও নয়, ভিন্ন ধরনের কোনো উদ্যোগ নিয়ে যাত্রাপথকে কেউ সহজ করে দেয়নি। দিনে মাত্র পাঁচ ঘণ্টার ঘুম, যেকোনো কাজকে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সবচেয়ে ভালো করে তোলার প্রবণতা, নতুন কাজের চ্যালেঞ্জ নেওয়া, শেখার আগ্রহ, আপাদমস্তক পরিশ্রম আর পাশে থাকা পরিবার এই নিয়েই মাদ্রাজের রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বহুজাতিক বিলিয়ন ডলার কোম্পানি পেপসিকোর চেয়ারপার্সন এবং তপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন ইন্দ্রা নুয়ি।

রূপকথার মতো শোনালেও তা সত্য, এক অনন্য উদাহরণ। আর এই ইতিহাস তৈরি করে সারা বিশ্বের কর্মজীবী নারীদের প্রতিনিয়ত আত্মবিশ্বাসী, প্রত্যয়ী, অনুপ্রাণিত করে চলেছেন ইন্দ্রা নুয়ি।

“মাই লাইফ ইন ফুল” ৩০০ পাতার আত্মজীবনীমূলক বইয়ে ‘ইন্দ্রা নুয়ি’ হয়ে ওঠার গল্পটা বলেছেন তিনি নিজে। অক্ষরের বুননে নির্মিত হয়েছে একজন পুরোদস্তুর ‘বিজনেস ওম্যান’ এর প্রতিকৃতি, যিনি আবার সংসার জীবনেও পুরোপুরি সফল।

প্রাচ্য, পাশ্চাত্য এমনকি আমাদের দেশেও নারীর ব্যবসা পরিচালনার উদাহরণ পাওয়া যায়। তবে ইন্দ্রা নুয়ি বিশেষ। ফরচুন ৫০ তালিকায় থাকা কোম্পানিতে অভিবাসী নারী সিইও তিনিই প্রথম। তার নেতৃত্ব থাকাকালীন পেপসিকোর মুনাফার পরিসংখ্যান তাক লাগিয়ে দেয়ার মতোই। পেপসিকোর ‘হেলদিয়ার প্রোডাক্ট’-এ বদলে যাওয়ার দিকের যাত্রা তার সময়েই শুরু।

তবে এসব পরিসংখ্যানের পাশাপাশি পৃথিবী জুড়ে কর্মজীবন আর পারিবারিক জীবনে ভারসাম্য তৈরি যত সফল উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা হয় তার শীর্ষে আছেন ইন্দ্রা। যাকে বলে স্বামী আর দুই কন্যা সন্তান নিয়ে পুরোদস্তুর সুখী পরিবার।

শৈশবে পরিবার থেকেই পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে ওঠার প্রেরণা পান। ইন্দ্রার বাবা বলেছিলেন, ‘তোমাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখানোর জন্য আমরা আমাদের সব বিনিয়োগ করছি লেখাপড়ার পেছনে। বাকিটা তোমাদের দায়িত্ব, তুমি তোমার মতো হও।’

যৌথ পরিবারে বড় হয়ে ওঠা ইন্দ্রা ভাবতেন পরীক্ষায় খারাপ করে কোনোভাবেই বাবা-মায়ের অসম্মান করা যাবে না। পড়ালেখায় মনোযোগের পাশাপাশি ডিবেটিং, গানের দল সবকিছুতেই ছিল তার সমান পদচারণা।

কৈশোরের এই বেড়ে ওঠায় পরবর্তীতে তাকে কাজে আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করেছে বলেই মনে করেন ইন্দ্রা। মাদ্রাজে স্কুল কলেজের পাঠ চুকিয়ে আইআইএম, কলকাতা সেখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি। একটি বাক্যে লেখাপড়ার যাত্রার বর্ণনা থাকলে বইয়ে এর বিস্তারিতই তুলে ধরেছেন ইন্দ্রা। সেখানে মাঝারি মানের গ্রেড পাওয়া শিক্ষার্থী স্কলারশিপ আর অন্য সব খরচ জুগিয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার গল্প নিঃসন্দেহে যেকোনো শিক্ষার্থীকে সাহস জোগাবে।

ইন্দ্রা বিশ্বাস করতেন কর্মজীবন কোনো ‘আলাদা’ বিষয় না। বইয়ে তিনি বলেছেন, কোনো কাজ করার পর যে স্বীকৃতি মেলে এবং আর্থিক নিশ্চয়তা মেলে তা গুরুত্ব নিয়ে খুব তর্কের অবকাশ নেই। নিজেদের স্বাধীনতার জন্যই নারীর উপার্জন করতে পারা জরুরি। নারীর আর্থিক উপার্জন গ্রহণ করার মাধ্যমেই সভ্যতা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

যারা এখনো ভাবেন নারীর জন্য কর্মজীবন ‘আলাদা’ তাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য ইন্দ্রার এই দীপ্ত উচ্চারণ শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।

ইয়েলের ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার পরে তার পরিচয় হয় টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার রাজ নুয়ির সঙ্গে। পরবর্তীতে তার সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন ইন্দ্রা। তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক আর বোঝাপড়ার অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। ইন্দ্রার মতে তার জীবনে তিনি ভালো যা কিছু পেয়েছেন তার অন্যতম রাজ।

সংসার জীবনে সন্তানদের বড় করে তোলার পথে তাদের দুজনের যৌথ দায়িত্ব নেওয়ার কারণে সংসার আর কর্মক্ষেত্র দুটোতেই সমান তালে এগিয়েছেন তিনি। সংসার সন্তানের সব কাজ একা নারীকেই করতে হবে, মানে চাকরি করলেও সংসারের সব দায়িত্ব নারীরই থাকবে এই ধারণার ঘোর বিরোধী তিনি। তার মতে, সংসারে স্বামী-স্ত্রীর ‘পার্টনারশিপ’টা খুব জরুরি।

সন্তানরা যখন ছোট তখন তাদের দেখাশোনা, লেখাপড়া সব নিয়েই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন ইন্দ্রা-রাজ। সন্তান পালন নিয়ে এই দম্পতির সংগ্রামের গল্পটার সাথে যেকোনো কর্মজীবী দম্পতির গল্পের হুবহু মিল পাওয়া যাবে। ভিন্নতা যেখানে তা হলো দুজনের বোঝাপড়ার মাধ্যমে কাজের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া।

কাজের সূত্রে ইন্দ্রা এবং রাজ দুজনকেই দেশে-বিদেশে ছুটতে হতো। কিন্তু সন্তানরা যখন ছোট তখন তাদের সিদ্ধান্ত ছিল এক রাতের জন্য সন্তানদের একা রাখবেন না এবং তা তারা নিশ্চিতও করেছেন। এটা কেবল একটা উদাহরণ।

সবক্ষেত্রেই দুজন মিলে সমস্যা সমাধান ছিল তাদের বড় শক্তি। ইন্দ্রার মতে অনেক বেশি পরিকল্পনা করতে হয়, কিন্তু পরিকল্পনা করলে সংসারের দায়িত্বও চাকরি সামলেই পালন করা সম্ভব। কেবল মা হিসেবেই নয়, সন্তান হিসেবেও ইন্দ্রা দায়িত্ব পালন করেছেন যথাযথ।

বাবার অসুস্থতার সময় সব ফেলে ইন্ডিয়াতে ছুটে যান। বাবার অসুস্থতার জন্য ছয় মাসের ছুটিও পেয়েছিলেন। বাবা যখন মারা যান তখন তিনি গর্ভবতী। তবে আপাদমস্তক কাজ পাগল মানুষটি কখনো কোনো কিছুতে সুযোগ নেননি।

তিনমাসের মাথায় আবারও চাকরিতে ফিরে বড় একটা প্রজেক্টের দায়িত্ব নেন তিনি। এমনকি দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের দ্বিতীয় দিনে তার প্রতিষ্ঠানের প্রধান তার সাথে নতুন একটি প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করেছে। ইন্দ্রা বলেন, তিনি সব তার নিজের পছন্দেই করেছেন, বাধ্যবাধকতার জন্য নয়। কাজের প্রতি ভালোবাসা আর দক্ষতা দিয়েই ইন্দ্রা ধাপে ধাপে এগিয়েছেন ক্যারিয়ারের সিঁড়ি।

ইন্দ্রা যখন বিসিজি ছেড়ে দেন তখন হঠাৎ একদিন তার সাবেক প্রধান কর্তার রেফারেন্স দিয়ে ফোন করেন ঐ প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ কর্মকর্তা। কারণ ঐ মানবসম্পদ কর্মকর্তাকে ইন্দ্রার সাবেক প্রধান কর্তা নতুন লোক নিয়োগের প্যারামিটার দিয়েছিল ‘একজন ইন্দ্রা নুয়ি’ খুঁজে বের কর। এমনতর ‘জব ডেসক্রিপশন’ এর কারণ ইন্দ্রা অনন্য। তিনি নিজেই নিজের প্যারামিটার।

বিসিজি, এবিবি, মটোরোলা, পেপসিকোর মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেওয়ার বর্ণনা পড়তে পড়তে সামনে এমন এক অবয়ব তৈরি হয় যা একজন সফল ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্বের। সেখানে নারী বা পুরুষের বিষয় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

ইন্দ্রা নারী বলে তাকে কেউ সহজ কাজ দেয়নি বা বাড়তি কোনো সুবিধাও তিনি নেননি। পরিশ্রম আর কাজ দিয়েই নিজেকে প্রমাণ করেছেন বারংবার। ইন্দ্রা বলেছেন, কর্পোরেট জগতে চূড়ায় পৌঁছানোর সিঁড়ি পুরুষের চেয়ে নারীর জন্য বেশি পিচ্ছিল। তবে কবে নারীর জন্য বিশেষ সুবিধা তৈরি হবে তার জন্য অপেক্ষা না করে পরিবার পাশে নিয়ে নিজের পথ নির্মাণ করতে চাইলে, তা যে সম্ভব সেই উদাহরণই তৈরি করেছেন ইন্দ্রা।  

এত এত সফলতা যার ঝুঁড়িতে সেই ইন্দ্রাও একসময় ভেবেছিলেন চাকরি ছাড়বেন। কিন্তু তার সক্ষমতার উপর পরিবারের আস্থা এবং পরিবারের অনুপ্রেরণা আর কাজের প্রতি ভালোবাসার তাগিদেই তিনি পথটা ছাড়েননি। এগিয়েছেন শ্রম দিয়ে, সাহস, সততা আর নিষ্ঠা নিয়ে।