ছবি : সংগৃহীত

অদিতি ফাল্গুনী লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। নব্বই দশকে গল্পকার হিসেবে বাংলা সাহিত্যে তার আবির্ভাব। এরপরে তিনি বিভিন্ন দিকে তার সৃজনশীলতা বিস্তৃত করেছেন। তবে গল্পকার সত্তা তিনি কখনো হারিয়ে যেতে দেননি।

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার নতুন গল্পের বই ‘ব্রাদার সিস্টার কাজি মাও সে তুং’। সাতটি গল্প স্থান পেয়েছে বইয়ে। বইয়ের গল্পগুলোয় বিভিন্ন বিষয় স্থান পেলেও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে এসেছে। এই বিষয়ে লেখকের বিশেষ পর্যবেক্ষণ আছে বলা যায়। এছাড়া গল্পগুলোয় উঠে এসেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিবিধ বিষয়।

বিষয়গুলো সুখের নয়। লেখক আমাদের দেখিয়ে দেন যে আমাদের দৃশ্যমান বাস্তবতার আড়ালে ভিন্ন এক বাস্তবতা রয়েছে যা আমরা দেখি না বা দেখলে না-দেখার ভান করে থাকি।

প্রথম গল্প 'কুয়াশার ফুল'। গল্পটি একাত্তরের একজন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে। যদিও গল্প বলা হয়েছে জগদীশ নামের এক উকিলের মাধ্যমে তবু গল্পকারের মনোভঙ্গি বুঝতে পারা যায় সহজেই। 'বনশ্রী' নামের বীরাঙ্গনার সাথে জগদীশের একটা সম্পর্ক-সূত্রও রয়েছে। বলা যায় বনশ্রীকে সামনে আনতেই জগদীশকে আনা। না হয় বনশ্রীর যে বর্তমান অবস্থা, তাতে করে তাকে দিয়ে গল্প বলানো একটা সমস্যার ব্যাপারই হয়ে দাঁড়ায়, কেননা তিনি সবদিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।

জগদীশের দয়ায় তিনি একটি মার্কেটের টয়লেট পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। জগদীশ অতি তরুণ বয়সে বনশ্রীর রূপ-মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। এমনকি নিজের বিয়ের প্রস্তাবটাও নিজেই নিয়ে যান। কিন্তু বিয়ে তো হয়নি বরং এটার জন্য তাকে ধিকৃত হতে হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> বাংলালিপি : উৎস ও বিবর্তন 

জাতের কারণে শিক্ষিত জগদীশের সাথে বিয়ে হয়নি উচ্চ জাতের বনশ্রীর। শুধু জগদীশই বা কেন, সেই সময়ে কলেজ পড়ুয়াদের সকলেরই আকর্ষণ ছিল বনশ্রীর প্রতি। একাত্তর সালে এই বনশ্রীর উপরই নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। সুন্দরী বনশ্রীর ওপর নজর পড়ে হায়েনাদের। রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে যায়।

পরে যা হওয়ার তাই হয়েছে। বনশ্রীর স্বামীও আর তাকে গ্রহণ করেনি। বনশ্রী তার সন্তানদেরও পায়নি। যুদ্ধ তাকে সর্বস্বান্ত করেছে। একাত্তরে নারীরা কীভাবে নির্যাতিত হয়েছে তার একটি জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত 'বনশ্রী'। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো বনশ্রীরা নিজের পরিবারে ফেরার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছিল।

উচ্চবর্ণের, সুন্দরী বনশ্রীর পরিণতি কত নির্মমভাবে হয়েছে তা দেখা গেল বার্ধক্যে এসে, বলতে গেলে মেথরের কাজ নেওয়ার মাধ্যমে। মার্কেটে আসা মানুষদের মল নির্যাসের জায়গা পরিষ্কার করতে হয় তাকে। কিন্তু মল কী আসলে পরিষ্কার হয়? বছরের পর বছর ধরে যে মল লেগে আছে মননে তা কী আর সহজে পরিষ্কার হবে?

যদি হতোই তাহলে যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারাবরণকারী রাজাকারের ছেলের, যে আবার সুবিধাবাদী আচরণের জন্য তিন বছর আগে সরকারি দলে নাম লিখিয়েছে তার তৈরি মার্কেটে বনশ্রীর কাজ নিতে হলো? ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস যে, যাদের কারণে বনশ্রী তার সবকিছু হারিয়ে একা হয়ে গিয়েছিল তাদের একজনের প্রতিষ্ঠানেই তাকে মল পরিষ্কারের কাজ করতে হয়েছে।

যারা দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে তারা আজ খুব ভালো অবস্থানে আছে আর যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য মান, সম্ভ্রম, ইজ্জত, পরিবার, সমাজ হারিয়েছে তারা জীবনের বোঝা টানতে গিয়ে অতি নিম্ন শ্রেণির কাজে নিয়োজিত হয়েছে।

‘কাজি মাও সে তুং'-আরেকটি গল্প। প্রকৃতিগতভাবে সে পুরুষ হলেও তার মধ্যে নারী-স্বভাবের প্রাধান্য দেখা যায়। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এই স্বভাবের জন্য তাকে নিজের মায়ের ভর্ৎসনাও সইতে হয়েছে। আর পারিবারিক বলয়ের বাইরে তার তো জীবন তো কেবল এই ভর্ৎসনাতেই ভরপুর।

ছাত্র জীবনে যেমন তাকে বিরূপ অবস্থার মোকাবিলা করতে হয়েছে তেমনি পেশাগত জীবনেও সে এই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। মাও সে তুং নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে চেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। শাড়ি পরে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া নিয়ে তৈরি জটিলতার কারণে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> রাষ্ট্রভাষা: বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? 

যদিও দুজন মহিলা দুটি ভিন্ন অবস্থান থেকে তার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তাকে রক্ষা করতে পারেনি। তবে জীবনের এই পর্যায়ে এসে তার একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়। আদর্শগত কারণে যে মহিলা তার পক্ষে ছিলেন তার সহযোগিতার মাধ্যমেই সে এই সুবিধাটুকু পায়।

‘মাও সে তুং’ এমন প্রান্তিক এক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে যারা সমাজের কাছে খুবই অবহেলিত। সে না-নারী, না-পুরুষ, না-হিজরা। সমাজের ভেতরে থেকেও তারা যেন এর বাইরে অবস্থান করে। 'লেডিস' টাইপ এই মানুষেরা তাই কেবল চারপাশের ত্যাড়া চোখের চাহনির শিকার হয়।

মহান বিপ্লবী নেতা 'মাও সে তুং'-এর কবিতার উদ্ধৃতি ব্যবহৃত হয়েছে এই গল্পে। তিনি বিপ্লবের জন্য বেছে নিতে চান নারী বা পুরুষকে। 'মাও সে তুং' এর মতো 'লেডিস' টাইপ মানুষদের নয়। কিন্তু তার বিপ্লবও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়—তোমাদের কাছে বীরত্ব মানে শুধু পুরুষ নয়, নারীর কাঁধেও রাইফেল বওয়া! বীরত্ব মানে শুধুই লং মার্চ। আর বগুড়ার মফস্বলি গলি থেকে ঢাকার নর্থ-সাউথে পড়া, ফেসবুকে একটু আগের সাদা ম্যাক্সি আর গ্লিটারিং নেইল পলিশে ছবি আপলোড করা বুঝি কোনো লং মার্চের চেয়ে কম? তবে সে কেন নয় সত্যিই মহা বীর, মহা বিপ্লবী মাও সে তুং?

'অশ্লেষার রাক্ষসীবেলায়' এক নারী মুক্তিযোদ্ধার গল্প। গল্প কথক একজন নারী সাংবাদিক। সাংবাদিকতার সূত্রেই এই মুক্তিযোদ্ধার কাছে তার আগমন। মূলত উনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার মাধ্যমেই গল্পের কাহিনি অগ্রসর হয়। এই নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম রহিমা বেগম।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তার বয়স অল্প। তিনি ঋতুবতীও হননি। তিনি সাংবাদিককে বলেন যে অনেকটা জেদ ধরেই মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বয়স কম বলে ক্যাম্প থেকে তাকে ইনফর্মারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

এই বয়সে এমন সাহসিকতার প্রদর্শন সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মন উৎসুক হয়। যাই হোক শেষ পর্যন্ত তার প্রকৃত পরিচয় পেয়ে যায় রাজাকাররা। তাদের কাছ থেকে পালাতে গিয়ে মিলিটারি জিপের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে থাকেন কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না।

পায়ে গুলি খেয়ে তাকে থেমে যেতে হয়। অতঃপর পাকসেনাদের হাতে বন্দি এবং আরও অনেক নারীর মতো গণধর্ষণের শিকার। সবচেয়ে আশ্চর্যের দিক হলো দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ফিরে এলে পরিবার তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।

ঘটনা পরম্পরায় এক বয়স্ক লোকের সাথে তার বিয়ে হয়। এই মুক্তিযোদ্ধা আজীবন যুদ্ধ করেই গেলেন এমনকি এখনো, যে সময়ে গল্পটি লেখা হচ্ছে সেই সময়েও, মুক্তিযোদ্ধার সনদ থাকার পরও লোকজন তার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়।

আরও পড়ুন >>> একুশের উচ্চারণ দূর হ দুঃশাসন 

“আমি পথে বের হতে পিছু পিছু সেই রহিমার প্রতিবেশী আসেন।

- রহিমার বাসায় আপনেরা প্রায়ই আসেন ক্যান

- আমরা মানে? আমরা কারা?

- আপনেরা মানে সাংবাদিকরা? ওর নামে লিখা লিখা গবমেন্টরে বইলা ওরে টেকা দিবেন? কি ধান্দা জানে মেয়েলোকটা।

মহিলা ফোঁস ফোঁস করে। আমি সামনে এগোতে থাকি। পেছন থেকে চায়ের দোকানের জটলার বিচিত্র সব মন্তব্য শুনতে পাই, 'এই রহিমা খুব চালাক। আসলে কি যুদ্ধ করছে নাকি?”

'বোবা ও কানী' গল্পে প্রান্তিক মানুষের দুঃখ কথা বর্ণিত হয়েছে। 'আতরজান' ও 'ফুলজান' দুই বোনের জীবনের করুণ বাস্তবতার ওপর আলোকপাত করেছেন লেখক। ফলে গল্পটি শেষ পর্যন্ত আর এককেন্দ্রিক থাকে না। মুক্তিযুদ্ধ, চিংড়ি ঘেরের কারণে জমির কর্ষণ ক্ষমতা বিনষ্ট হওয়া, কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের দুঃসহ অবস্থা ইত্যাদি বিষয় এই গল্পে এসেছে। এই গল্প শুধুই গল্প হয়ে থাকে না।

নিম্নবর্গের মানুষের জীবনযাত্রার এক বাস্তব বয়ান হয়েও থেকে যায়। ফুলজান কথা বলতে পারে না। অনেক কিছু পেরিয়ে তার বিয়ে হয়। একজন নাছোড়বান্দা হয়ে তাকে বিয়ে করে। সন্তান হয়। এরা প্রকৃতির নিয়মে বড় হয়। মেয়েদের বিয়ে হয়। কিন্তু এক মেয়েকে ফিরে আসতে হয় মায়ের কাছে।

গল্পের শেষে এসে দেখা যায় ফুলজানের এক ছেলেকে র‌্যাব ধরে নিয়ে যায়। ফুলজানের জীবনে যেন সুখের কিছুই নেই। গল্পের প্রেক্ষাপট দীর্ঘসময় ধরে নির্মিত হতে। ফলে দুই বোনের জীবনচলার বিষগুলোর উপর লেখক আলো ফেলতে পারেন। পাঠক এই গল্পের চরিত্র ও ঘটনাগুলোর ভেতর দিয়ে যাত্রা করে একরাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারেন এই ভেবে যে মানুষের জীবন এরকমও হতে পারে!

আরও পড়ুন >>> সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন এবং বাস্তবের ফাঁক-ফাঁকি 

'টয়লেট পরিষ্কারের পরে' গল্পের কাহিনিতেও আছে মুক্তিযুদ্ধ। একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের করুণ পরিণতি এই গল্পের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। জীবন বাজি রেখে যে মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গুত্ব বরণ করে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছেন। তার নাতিকে সরকারি কর্মচারী ডিসি'র বাসায় 'কাজের ছেলে' হিসেবে কাজ করতে হয়। তাকে বাসা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এমনকি টয়লেট পরিষ্কারের কাজও করতে হয়।

এই গল্পে এসেছে সাম্প্রতিক অতীতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের কথাও। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সবধরনের কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে তরুণরা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার নাতি যে টয়লেট পরিষ্কার করে সে খবর কারও জানা নেই। সব মুক্তিযোদ্ধা সুবিধাপ্রাপ্ত নয় এই গল্পের মাধ্যমে সেই ব্যাপারটিও তোলে ধরা হয়েছে। অথচ আমরা চোখের সামনেই দেখতে পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা কত রাষ্ট্রীয় সুবিধা আদায় করে নিয়েছে।

গল্পের কিশোর ছেলেটির বিদ্যমান চাকরিটিও একসময় থাকে না ডিসির স্ত্রীর নির্দেশমতো কাজ না করার কারণে। সে শুধু চেয়েছিল পেটের ক্ষুধা মিটিয়ে কাজগুলো করবে। কিন্তু সেই সুযোগ আর পায়নি। এর শাস্তি স্বরূপ এই কিশোরের মুক্তিযোদ্ধা দাদাকে ডিসি ফোন করে জানিয়ে দেন যে তার নাতিকে আর চাকরিতে রাখা হচ্ছে না।

এই ঘটনায় বৃদ্ধ মানুষটি অসুস্থ হয়ে পড়েন। লোকজন ধরাধরি করে যখন তাকে হাসপাতালে নিচ্ছে তখন তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। লেখকের বয়ানে মৃত্যুপথযাত্রী মুক্তিযোদ্ধার মনের কথা যেন আমাদের ওপর সত্যিই থুতু ছিটায়—“দুনিয়ার সব বাতাস শেষ হইয়া আসতেছে। ভৈরব নদের উপর আমার হাতেই মাথা রাইখা মরলো নির্মল, সিরাজুল, বাদশা পঁচিশ বছর বয়স হইতে বিছানা নিলাম। আর আমার নাতির চাকরের কাজও থাহে না। আমি মরলে-আমি মরলে-য্যানো কেউ জাতীয় পতাকা না উঠায়। কোনো 'গার্ড অফ অনার' না দ্যায়। আমি থুতু ফিক্কা মারলাম-থুতু ফিক্কা মারলাম এই 'গার্ড অফ অনারে।”

'প্রসাদের একদিন' এক তরুণের আত্মহননের গল্প। 'প্রসাদ' নামের তরুণটি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। একটি গরিব পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেটি উচ্চাশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। টাকার অভাবে সে টিউশনি করেছে। কিন্তু বিধিবাম এক সময় এই টিউশনিগুলোও চলে যায়। ফলে ক্যান্টিনে খেয়ে বাকি পড়ে যায় বেশকিছু টাকা।

ক্যান্টিনের মালিক বাকির টাকা চাইলে বাড়ি গিয়ে কিছু টাকা নিয়ে আসে। কিন্তু বাকির পরিমাণের তুলনায় এটা নিতান্তই অল্প। অবশিষ্ট টাকা যে পরিশোধ করবে তারও উপায় নেই। যদিও ক্যান্টিন মালিকের জিজ্ঞাসার জবাবে সে বলেছে—'রব ভাই-বাবা সামনের সপ্তাহে আমার হোস্টেলে আসবে। তখন এই কয়দিন হাটে ফল-ফসল বেচে যা পাবে, সব টাকা নিয়ে আসবে বলেছে।' কিন্তু প্রসাদ জানে তার বাবা টাকা নিয়ে আসতে পারবে না। ফলে শেষ পর্যন্ত সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যার আগে অবশ্য সে ভালো করে খেয়ে নেয়।

আরও পড়ুন >>> পোশাকে ভাষা আন্দোলন 

হৃদয় ছোঁয়া গল্প এটি। গল্প পড়ার সাথে সাথে মাথায় প্রশ্নও জাগে যে কেবল টাকার অভাবের জন্য একটি মেধাবী ছাত্র এভাবে নিজেকে বিনাশা করে দেবে? গল্পের শুরুতেই বাম ছাত্র সংগঠনের পোস্টারের লেখাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ—'ডাইনিংয়ে ক্যান্টিনে সাবসিডি দিতে হবে।’

খাবারের জন্য ছাত্রদের, বিশেষ করে প্রসাদের মতো ছাত্রদের, যারা গরিব পরিবার থেকে মেধার জোরে উঠে এসেছে তাদের যে নিদারুণ কষ্ট পোহাতে হয় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে প্রসাদের মৃত্যুর মাধ্যমে।

'অনঙ্গ এপিটাফমালা' গল্পে তিনজন ব্যক্তির দেখা মেলে। এদের একজন 'তৃণা', যে মৃত। অন্য দুইজন 'সোহানুল হক শাওন' ও 'তানভির মোহাম্মদ'। তৃণা মৃত হলেও গল্পের কেন্দ্রে সে-ই আছে। গল্পের এই দুজন পুরুষই সুন্দরী ও ব্যক্তিত্ববান তৃণাকে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা আর হয়নি।

একপর্যায়ে তারা নিজেরা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তৃণার সাথে কারও যোগাযোগ থাকেনি। কবরস্থানের ভেতরে দুজন মানুষের অবস্থান বেঁধে রেখে পুরো গল্পটি বলা হলেও এদের স্বগত কথনের মাধ্যমেই আসলে গল্প গড়ে ওঠে।

গল্প পাঠ শেষে তৃণার জন্য একটা বেদনাবোধ জেগে ওঠে। সে কী আসলে আমাদের এই নষ্ট সমাজের কাছে হেরেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো!

‘ব্রাদার সিস্টার কাজি মাও সে তুং’ বইয়ের গল্পগুলো আমাদের সমাজ বাস্তবতা থেকেই তুলে আনা হয়েছে। নষ্ট সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের মেথরের কাজ করতে হয়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্দেহ করা হয় যে তারা আসলেই মুক্তিযোদ্ধা কি না, মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারীদের সরকারি কর্মচারীর বাসভবনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে হয়।

নষ্ট সমাজেই সর্বস্বান্ত হতে হয় কিছু মানুষকে যারা অপরাধ না-করেও অপরাধী হয়। এই ধরনের সমাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে টাকার জন্য আত্মহত্যা করতে হয়। গল্পগুলো আমাদের বিদ্যমান সমাজ বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ তৈরি করে দেবে।

সংক্ষেপে বই সম্পর্কে:

বইয়ের নাম : ব্রাদার সিস্টার কাজি মাও সে তুং
লেখক : অদিতি ফাল্গুনী
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
প্রকাশক : ঐতিহ্য
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২৩
মূল্য : ২৫০ টাকা