পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী চার দিন পর শেষ হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত এবারের মেলায় ২ হাজার ৮৩৫টি নতুন বই এসেছে। এত বইয়ের মধ্যে কয়টি পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কারণ এবারের মেলায় বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ ও পুরোনো প্রথিতযশা লেখকদের বই বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

মেলায় প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের মেলায় তরুণ লেখকদের চেয়ে প্রথিতযশা পুরোনো লেখক হুমায়ন আহমেদ, হুমায়ন আজাদ, আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। তরুণ লেখকদের মধ্যে সাদাত হোসাইনের বই বেশি বিক্রি হয়। তার বাইরে সাব্বির জাদিদ, আফতাব হোসেন, অন্তিক মাহমুদ ও ফারজানা ববির বই কমবেশি বিক্রি হচ্ছে।

প্রকাশকরা বলছেন, তরুণ লেখকদের মানসম্মত পাণ্ডুলিপির অভাব রয়েছে। এছাড়া সম্পাদনাও দুর্বল। বাংলাদেশের তরুণ লেখক মানুষ চেনে না। কারণ তারা পত্রপত্রিকায় লিখে নিজেদের পরিচিত না বাড়িয়ে বই প্রকাশ করতে চলে আসে। যার ফলে তাদের বই পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। আবার অনেক ভালো বই উপযুক্ত প্রচার-প্রচারণার কারণে আড়ালে থেকে যায়। তবে এসব বই কখনো না কখনো পাঠকের কাছে ঠিকই পৌঁছে যায়।

আগামী প্রকাশনীর মালিক ওসমান গণি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তরুণ লেখক যাদের বলছেন, তাদের তো আগে বই পড়তে হবে। তারপর তো লিখবে। তারা পত্র-পত্রিকায় লিখবে। কিন্তু সেটা না করেই তারা বই বের করতে পাগল হয়ে যায়। যার ফলে এসব বই কেজি ধরে বিক্রি করতে হয়।

তিনি বলেন, আমাদের হুমায়ুন আজাদ, আহমেদ শরিফ, সলিমুল্লাহ খান, সৈয়দ আবুল মুকসুদ এবং মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বই বেশি বিক্রি হয়।

লেখকদের ভাষ্য, বাংলাদেশের মানুষ খুব বেশি বই পড়ে না। আর বাংলাদেশে জীবিত লেখকরা খুব বেশি সম্মানও পায় না। মৃত্যুর পর এ দেশে কবি-সাহিত্যিকদের সম্মান বাড়ে। জীবিত থাকাকালে জীবনানন্দ দাশের কবিতার বইও মানুষ কিনত না। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বইও ৩০০ কপি ছাপানো হয়েছিল।

লেখক আনিসুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের বই নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। তারা পড়ে না। প্রবীণ-নবীন কোনো কিছুই পড়ে না। কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু তার বিদ্রোহী কবিতাটা পড়ে কেউ তার মর্ম বুঝেনি। তারা মর্ম বোঝারও চেষ্টা করে না। কিন্তু যারা ভালো লেখক তারা টিকে থাকেন।

তিনি বলেন, জীবনানন্দ দাশ যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তার কবিতাও বিক্রি হতো না। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই ৩০০ কপি বের হয়েছিল। কিন্তু তারা টিকে গেছেন। আমাদের শহীদুল জহির নামে একজন লেখক ছিলেন। জীবিত থাকতে একটু একটু করে মানুষ জেনেছে যে তিনি ভালো লেখক। কিন্তু এখন তার কথা শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, জার্মানির মানুষও জানেন। সুতরাং এক বইমেলায় কার বই বেশি বিক্রি হলো সেটা ব্যাপার নয়। ধীরে ধীরে যাদের বই পড়ে মানুষ আবার ফিরে আসবে, যারা কালের বিচারে টিকে যাবে তারাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সুতরাং এটা তো হট কেক না যে আজকেই বিক্রি হতে হবে। বই একটা মহাকালীন বিষয়। যেকোনো সময় বিক্রি হতে পারে।

ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী লালিব জানান, তাদের প্রকাশনী থেকে এবার দুই শতাধিক বই বের হয়েছে। তার মধ্যে লেখক সাব্বির জাদিদের আজাদির সন্তান ও আফতাব হোসেনের লেখা অনুবাদ গ্রন্থ বখতিয়ার বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া এবারের মেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বইয়ের সেট বেশি বিক্রি হচ্ছে।

জার্নিম্যান বুকসের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাওন সরকার বলেন, এবারের মেলায় অনুবাদ গ্রন্থের প্রতি পাঠকের আকর্ষণ বেশি। অনুবাদ গ্রন্থগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে। অনুবাদের পাশাপাশি আমাদের লেখকদের নিজস্ব বইও বিক্রি হচ্ছে।

তিনি জানান, মেলায় সোহেল ইমাম খানের লেখা ‘যৌন্দর্য কথাঃ শিল্পকলা ও নন্দনতত্ত্ব’ বইটি বেশি বিক্রি হচ্ছে।

প্রতীক প্রকাশনীর বিক্রয় কর্মী মো. সাইফুল্লাহ জানান, এবারের মেলায় তাদের বেশি পাঠক টানছে অনুবাদ গ্রন্থ ‘নেপোলিয়ন হিলে থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ নামের বইটি। এটি অনুবাদ করেছেন মো. শওকত আলী।

অবসর প্রকাশনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত মুইনুদ্দিন জানান, এবারের মেলায় তাদের শতাধিক নতুন বই এসেছে। তার মধ্যে সালমান হকের অনুবাদ গ্রন্থ ‘মরিসাকি বইঘরের দিনগুলো’ বেশি বিক্রি হচ্ছে।

মাওলা ব্রাদার্সের বিক্রয় কর্মী সাইদুল হক বলেন, এবারের মেলায় তাদের নতুন বইয়ের চেয়ে কাজী নজরুল ইসলাম, আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ন আহমেদ ও সরদার ফজলুল হকের বই বেশি বিক্রি হচ্ছে।

নতুন লেখকদের বই না কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসমাইল হোসেন নামের একজন পাঠক বলেন, এত বই তো পড়া সম্ভব না। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় নতুন লেখকের বইয়ে যা ইচ্ছে তা লেখা। তখন মন খারাপ হয়ে যায়। যার কারণে নতুন লেখকদের বই না কিনে পুরোনো লেখকের বই কিনি। সত্য কথা হচ্ছে, আমাদের নতুন লেখকের চাইতে বিদেশি অনুবাদ সাহিত্যগুলো বেশি ভালো।

এএইচআর/এসএসএইচ