বাস্তববাদী কবি সৌম্য সালেক সমীহ জাগানো শব্দ-নৈপুণ্যে সৃষ্টি করেছেন ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’ কবিতা গ্রন্থটি। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোয় তিনি মানব জীবনের সৌন্দর্য ও যন্ত্রণা তুলে ধরেছেন। কবিতার শব্দচয়নে সৌম্য সালেক সচেতন। তার কাব্যভাষা বুদ্ধিদীপ্ত, ভাব মূর্ছনা প্রশংসনীয়। তিনি আমাদের প্রতিদিনের অস্তিত্বের সংবেদনশীলতাকে স্বীকার করেন।

কবি সন্ধানী দৃষ্টিতে প্রেমের স্বরূপ উদঘাটন করতে গিয়ে দেখেছেন জীবনের বহুমাত্রিকতা নিষ্ঠুর সত্যের আবরণে ঢাকা পড়ে আছে। তাই তিনি ‘নীল রাতে’ কবিতায় বলেছেন, ‘এখন কেউ আছে তামাদি তোরণ খুঁড়ে/ কেউ বায় ক্ষত-অশ্রু-উজান বুকে/ নতুনের আবাহনী গায় সুখী/ কেউবা হতেছে লীন, মধুহীন রাত চষে/ আবার কেউ কেউ চিত হয়ে পড়ে থাকে/ রতি ও রাতের জখমে খুনে লাল...’।

কবি অনাবৃত ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় বারবার নিমজ্জিত হতে গিয়ে দেখেছেন শুধু অসঙ্গতি ও অনিয়ন্ত্রিত গতি। ‘ফাঁস’ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘আতঙ্কে উৎপীড়নে আজ অবরূদ্ধ মানব হৃদয়/এই নিরুদ্ধ নিষ্পেষণে একদিন হৃদয়গুলো মরে যাবে/ তখন জীবন্মৃত মানুষের সঙ্গমে/ উৎপন্ন হবে বোবা কালা অসংখ্য রোবট/পৃথিবী দানব যন্ত্রের বশে যাবে, মানুষ হারাবে অধিবাস।’

আলোচ্য গ্রন্থের কিছু কবিতায় মানবাত্মার ভোগান্তির প্রতিক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। জার্মান কবি নেলি শ্যাচ যেমন বলেছেন, ‘আমার কণ্ঠ পালিয়ে গেছে/ সেটি আর কথা বলতে পারে না।’ ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’ গ্রন্থের ‘কতিপয় বিচিত্র মুহূর্তের টীকা’ কবিতায় এমন ভাবের অনুরণন দেখতে পাই। তিনি বলেন, ‘রমনা পার্কে বৃক্ষদের অবিশ্রাম পাতা ঝরা দেখে ভাবনাকুল একদল পরী/ ইস, ওরা যদি অমৌসুম হতো, অকাল ঋতুর দোষে ফুরাতোনা শ্যামল/ সুরভী, অনাহূত শীত এসে নষ্ট হলো কুঞ্জ কানন/ কেন ভাঙ্গে পুষ্পসাজ, কেন এই পাতার রোদন/ প্রেমিকের বাহুডোর থেকে ভাবে ওরা ব্যথাতুর মনে/ ঊষর প্রান্ত হতে চুপে চুপে আমি আজ শুনেছি সেসব।’

আবেগের বাহুল্যবর্জিত ঋজু মেরুদণ্ডের একজন বলিষ্ঠ পুরুষের রূপই কবির ব্যক্তিত্বে পরিস্ফুট। এ গ্রন্থে জীবন সম্পর্কে তার শিল্প দৃষ্টি রসসিক্ত নয়, বোধদীপ্ত। ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’ গ্রন্থের কবিতা শৈলী ও রূপকর্মেরও একই বৈশিষ্ট্য। তার বাক্য বলিষ্ঠ ও ক্ষুরধার। তিনি ‘গণায়ন’ কবিতায় বলেছেন, ‘রক্ত জেগেছে আজ বিভেদের-পাষাণ রোধিতে/ আগুন লেগেছে তাই প্রাঙ্গণের উদাম বেদীতে/ আমার ভায়েরা আছে রাজপথে ঈশানে-নিশানে/ তাদের বোনেরা হাঁকে উদ্দাম রুদ্র-বিষাণে...।’

‘পাতা ঝরার অর্কেস্ট্রা’ কাব্যগ্রন্থে প্রতিদিনের খুঁটিনাটি তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়। কবি তার বেশ কিছু কবিতায় বাস্তবতাকে স্পষ্ট অনুমোদনের জন্য জৈবিক অনুষঙ্গে প্রকাশ করেছেন। যেমন, তিনি ‘বস্ত্র হরণ’ গদ্য কবিতায় বলেছেন, ‘টেনে-হেঁচড়ে ওরা আমাকে উলঙ্গ করেছে স্তনগুটি, চর্মসন্ধি, লিঙ্গ ও লালা এসব দৃশ্যমান কদর্যতা ছাড়া ওরা যে কিছুই খুঁজে পাবে না এ বিষয়ে একজন পূর্বেই বলেছিল , আসলে ওরা হটে-নি!’

‘অধিবেশন’ কবিতায় বৈশ্বিক সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির স্বরূপ তিনি স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে অসাধারণ ইঙ্গিতে উন্মোচন করেছেন। যেখানে মানুষের প্রাণ ধর্ম স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে হয়েছে বিকারগ্রস্ত ও স্বভাবচ্যূত। সেখানে কবির ঘৃণা প্রদীপ্ত প্রতীকী ভাষার বক্র হাসিতে কখনোও রয়েছে ভ্রুকুটি-কুটিল, কখনোও বহ্নি দাহন ও কখনোও রয়েছে কমনীয় অনুকম্পা।

গ্রন্থভুক্ত কবিতা পাঠের পর কবিকে শুধু জীবনের রূপকারই বলা যায় না তিনি তার ব্যাখ্যাকারও বটে। আমার বিশ্বাস বইটি পাঠকদের সমীহ আদায়ে সক্ষম হবে।

‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’য় সন্নিবেশিত হয়েছে মোট ৪৪টি কবিতা। বইটি প্রকাশ করেছে ‘সময় প্রকাশন’। প্রচ্ছদ শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ। মূল্য ১৬০ টাকা।