‘বিস্মৃতি’ শব্দটি আপাতভাবে নেতিবাচক মনে হলেও ‘বিস্মৃতির চাঁদপুর’ গ্রন্থে শব্দটি প্রয়োগের প্রয়াস শতভাগ ইতিবাচক সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। নিয়মিত চর্চিত হওয়ায় কিছু কিছু কিংবদন্তি হাজার বছর পরেও সতেজ থাকে, আর চর্চিত না হওয়ার কারণে কতিপয় সত্য ঘটনা সপ্তাহখানেক পুরনো হলেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়।

চাঁদপুর কয়েকশ বছরের প্রাচীন জনপদ। নামকরণ হতে শুরু করে এর নদীমাতৃক ভূ-প্রকৃতি, আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি ও ইলিশের প্রাকৃতিক বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে চাঁদপুর ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। সেই ইতিহাসকে চর্চার মধ্যে রেখে আগামী প্রজন্মকে নিজের শিকড়ের অতীত সম্পর্কে অবহিত করা একটি গুরুদায়িত্ব। এ দায়িত্বটুকু নিয়ে কাদের পলাশ ও মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের সম্পাদনায় প্রকাশ হয়েছে ‘বিস্মৃতির চাঁদপুর’।

সম্পাদকদ্বয় ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বিরল দলিলপত্র সংগ্রহ করে গ্রন্থভুক্ত করেছেন। চর্চার স্বল্পতা কিংবা অবহিতির আড়ালে গিয়ে তাদের ওপর বিস্মৃতির ধুলোর যে আস্তরণ পড়েছে, তা উৎপাটন করতে গ্রন্থটি একটি কার্যকর পদক্ষেপ। এজন্য তারা ধন্যবাদ প্রাপ্য।

গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে দুটো স্মৃতিকথা। একটি রবীন্দ্র সংগীতজ্ঞ শান্তিদেব ঘোষ লিখিত ‘আমার চাঁদপুর’ এবং অন্যটি কবি শঙ্খ ঘোষ লিখিত ‘মেঘনা ১৯৯৭’। শান্তিদেব ঘোষের বাল্যকালের স্মৃতিচারণে ১৯১০ সালের চাঁদপুর উঠে এসেছে। সেই লেখা সূত্রে জানা যায়, ১৯১৪ সালের দিকে চাঁদপুর শহরের এসব খালের বুকের ওপর দিয়ে পালতোলা নৌকায় নায়রীরা বাপের বাড়ির ঘাটে নামতেন।

অন্যসব স্থানের মতো তখনকার চাঁদপুরেও গৃহস্থ বধূরা ডুলি চড়ে যাতায়াত করতেন। শান্তিদেব খুবই স্মৃতিকাতর হয়ে চাঁদপুরকে এঁকেছেন তার শৈশবের স্মৃতিতে।

কবি শঙ্খ ঘোষের ‘মেঘনা ১৯৯৭’ লেখাটিও স্মৃতিকাতরময়। কবির মামাবাড়ি ছিল চাঁদপুরের নতুন বাজার। পথ চেনেন না বলে সে যাত্রায় আর মামাবাড়ি যাওয়া হয়নি তার।

সংকলনটিতে ১৯২১ সালে চাঁদপুরে সংগঠিত চা শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের নির্মম ঘটনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বিধৃত হয়েছে ১৯৩০ সালে সংগঠিত বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালীপদ কর্তৃক ভুলবশত তারিণী মুখার্জীকে হত্যার ঘটনাও।

১৯৩৭ সালের মে মাসে বহু ভাষাবিদ ও পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আগমন, ১৯৪৬ সালে দাঙ্গা থামাতে আসা মহাত্মা গান্ধী এবং ১৯৪৭ সালে পদধূলি রাখা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের স্মৃতি ধারণ করে চাঁদপুর ধন্য। ১৯২০ সালে এসেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, ১৯২৬-এ রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল এসেছিলেন ১৯২১ সালে। বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বেশ কয়েকবার এ জনপদে। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন এসেছেন একাধিকবার।
বিস্মৃতির চাঁদপুর আমাদের জানিয়ে দেয়, মুক্তিযুদ্ধের আট মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর তৈমুর আর সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের শওকতের অত্যাচারে মা-বোনেরা হারিয়েছিলেন তাদের ঐশ্বর্য।

চাঁদপুর রেলপথ, বোলপুরে দুর্ভিক্ষের ত্রাণ বিতরণে চাঁদপুরের নারীদের দুইশো পরিধেয় বস্ত্রদানের মাধ্যমে অংশগ্রহণ, ১৯৪৬-৪৭ সালে চাঁদপুরে দাঙ্গা পীড়িত মানুষের মধ্য রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃক ত্রাণ বিতরণসহ নানা বিষয় বিধৃত হয়েছে গ্রন্থটিতে।

বিস্মৃতির কাল নির্ধারণে সম্পাদকদের অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। নেতাজি সুভাষ বোস চাঁদপুরে দুইবার পদার্পণ করেন। তাকে নিয়ে গ্রন্থটিতে আলাদা পরিচ্ছেদ হতে পারতো। চিত্রলেখা সিনেমার পাশাপাশি ছায়াবাণী প্রেক্ষাগৃহের ছবিও সংযুক্তির দাবি রাখে। এছাড়াও ভূমিকায় চা বাগানের শ্রমিক হত্যার সাল ১৯২০ উল্লেখিত হলেও ভেতরের মূল পর্বে তা ১৯২১ বলেই উল্লেখিত হয়েছে। তথ্যের এই দ্বন্দ্ব অনিচ্ছাকৃত হলেও দৃষ্টিকটু।

চাঁদপুরের মতো মহকুমায় ১৯৬৩ সালে মাত্র পঁচিশ রুপির বিনিময়ে হেলিকপ্টারে যাত্রী পরিবহন করার তথ্যটি বেশ চমকপ্রদ। তবে এর সঙ্গে হেলিপ্যাডের স্থানটি উল্লেখ করা হলে এবিষয়ে তথ্যটি পূর্ণতা পেত। প্রচ্ছদের নামলিপিসহ উল্লিখিত কয়েকটি বিষয়ে সম্পাদকদ্বয় দৃষ্টি দিবেন বলে প্রত্যাশা করি।

গ্রন্থটি দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য কাজ। বইটি ভুলে যাওয়া চাঁদপুরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া থেকে ঠেকাতে প্রথম পদক্ষেপ। আশা করি, সম্পাদকদ্বয়ের ভাষ্য মোতাবেক এটি ধারাবাহিক আকারে চলমান থাকবে।

‘বিস্মৃতির চাঁদপুর’ প্রকাশ করেছে চৈতন্য প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু। ১৪৪ পৃষ্ঠার মূল্য রাখা হয়েছে ৩২০ টাকা। প্রকাশকাল অক্টোবর ২০২০।