‘নিজের জীবন নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে ফিরেছি। এক যুদ্ধ দেখে এসেছি কিয়েভে, তার চেয়ে বড় যুদ্ধ দেখেছি পোল্যান্ড বর্ডারে। দুই যুদ্ধ পার করে শেষ পর্যন্ত পোল্যান্ড আসতে পেরেছি, সেজন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া।’

মো. আব্দুল কাইয়ুম, বছর চারেক আগে ইউক্রেনে পাড়ি জমান উচ্চ শিক্ষার জন্য। রাজধানী কিয়েভে সবকিছু ভালোই চলছিল তার। যুদ্ধ সব হিসাব পাল্টে দেয়। পরিস্থিতি তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় অনিশ্চয়তার পথে। যুদ্ধ থেকে জীবন বাঁচাতে আরেক যুদ্ধের মুখে পড়েন তিনি। ঢাকা পোস্টের কাছে তুলে ধরেন সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।

কাইয়ুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি কিয়েভে থাকতাম। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতাম। গত কয়েকমাস ধরে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যে ঝামেলা চলছিল, আমরা ভেবেছিলাম ঠিক হয়ে যাবে। এটা যে যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে যাবে সেটা আঁচ করার আগেই রাশিয়া হামলা শুরু করে। বৃহস্পতিবার কিয়েভের চারদিকে বোমা পড়া শুরু হলো। বোমা এসে কোথায় পড়ছে তা বোঝার উপায় ছিল না। বোমার শব্দে চারদিকে কম্পন হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি। এক পর্যায়ে সবাই ছোটাছুটি করতে থাকল। যে যার মতো করে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিল।

ওইদিনই কাইয়ুম সিদ্ধান্ত নিলেন কিয়েভে থাকা তার জন্য নিরাপদ হবে না। কিছু শুকনো খাবার, পানি, মোবাইল চার্জারসহ সঙ্গে থাকা দুটি পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে পোল্যান্ডের বর্ডারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন।

তিনি বলেন, অনেকটা মৃত্যু হাতে নিয়েই বাসা থেকে বের হই। বাসা থেকে বের হয়ে দেখি, যে যার মতো ছুটছে। বেশিরভাগই বর্ডারের দিকে ছুটছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে যাদের নিজস্ব গাড়ির ব্যবস্থা আছে তারা ছাড়া অন্যরা পড়েছে বিপাকে। আমার সঙ্গে আরও কিছু বাংলাদেশি ছিল। গাড়ি না পেয়ে প্রায় সাত ঘণ্টা হাঁটলাম। মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় বিশ্রাম নিই। আর চেষ্টা ছিল গাড়ি পাওয়ার। দীর্ঘ পথ হাঁটার পর আমার সঙ্গে থাকা পাঁচ বাংলাদেশি মিলে আটশ ডলার দিয়ে একটি ট্যাক্সি ঠিক করি। কিন্তু ট্যাক্সি একটু এগোয় তো আবার থেমে যায়। রাস্তায় তীব্র যানজট।

কাইয়ুমের ভাষ্য মতে, যানজট ঠেলে ট্যাক্সি ধীরে ধীরে পোল্যান্ড বর্ডারের দিকে এগোতে থাকে। বর্ডার থেকে আট কিলোমিটার দূরে তাদের পৌঁছাতে সময় লেগে যায় প্রায় ১৮ ঘণ্টার মতো (স্বাভাবিক সময়ে কিয়েভ থেকে ট্যাক্সিতে করে আট ঘণ্টায় পার হওয়া যায় পোল্যান্ড বর্ডার)। এবার উপায় না পেয়ে দ্বিতীয় দফায় হাঁটতে থাকি। এর মধ্যে ব্যাগে থাকা শুকনো খাবারই ছিল ভরসা।

তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে খাওয়ার কথা চিন্তা করা যায় না। কিন্তু ব্যাগে করে আনা খাবারও শেষের পথে। বর্ডার থেকে আট থেকে নয় কিলোমিটার জুড়ে মানুষ আর মানুষ। কে কার আগে বর্ডার অতিক্রম করবে সেই প্রতিযোগিতা। সেখানে পৌঁছানোর আগেই দেখেছি, হুড়োহুড়িতে পড়ে গিয়ে অনেকে মারা গেছেন। তবে সংখ্যা বলতে পারব না। ইউক্রেনের নাগরিকদের তাদের সেনাবাহিনী আগে যেতে দিচ্ছিল। অনেক আফ্রিকান ছিল, তারা খুব শক্তিশালী হওয়ায় অন্যদের ঠেলে সামনে চলে যেতে থাকে।

এরমধ্যে ট্যাক্সিতে করে আসা অন্য চার বাংলাদেশিকে হারিয়ে ফেলেন কাইয়ুম। মোবাইলে চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। খেয়ে না খেয়ে, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে কাইয়ুমের পোল্যান্ড বর্ডারের কাছাকাছি পৌঁছাতে লেগে যায় দুইদিন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সময় রোববার তিনি পোল্যান্ড ইমিগ্রেশনের সামনে আসেন। সেখানে আসতেই মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি।

কাইয়ুমের ভাষায়, আট থেকে নয় কিলোমিটার রাস্তা পার হতে কী যুদ্ধটানাই করতে হয়েছে সেটা বলে বোঝাতে পারব না। যারা এখানে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন একমাত্র তারাই বুঝবেন। কিয়েভে যে যুদ্ধ, বোমা বা মানুষের ছোটাছুটি দেখেছি; তার চেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল পোল্যান্ড বর্ডারে। অনেকে এখানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধাক্কাধাক্কিত অনেকে মারাও গেছেন।

কাইয়ুমের কাছে বৈধ কাগজপত্র থাকায় পোল্যান্ড ইমিগ্রেশন তাকে ১৫ দিনের জন্য ট্রানজিট ভিসা দেয়। তবে অনেক বাংলাদেশির বৈধ কাগজপত্র না থাকায় সীমান্ত পার হতে পারেননি বলে জানান তিনি। বর্তমানে কাইয়ুম পোল্যান্ডে তার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের বাসায় উঠেছেন। তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন।

পোল্যান্ড প্রবেশ করতে পারা কাইয়ুম অন্য বাংলাদেশিদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ‘আমি চলে আসতে পেরেছি। কিন্তু অন্য বাংলাদেশি যারা এখনো বর্ডার পার হতে পারেননি বা যারা এখনো ইউক্রেনে আটকা পড়ে আছেন, তাদের জন্য কষ্ট হচ্ছে।’ 

এনআই/জেডএস